রাঙামাটি প্রতিবেদক:
রাঙামাটিতে পাহাড় ধসের ঘটনায় আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়ছেন দুর্গতরা। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে ফিরছেন বাড়িঘরে। কেউ কেউ যাচ্ছেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি। আর আশ্রয় কেন্দ্র স্থানান্তর করে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে অন্যদের যারা থাকছেন তাদেরকে। প্রশাসন সূত্রে এসব বিষয়ে তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
রাঙামাটি সরকারি কলেজ আশ্রয় কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. ছগির আহমদ বলেন, সেখানে আশ্রয় নেয়া ৮০ পরিবারের মধ্যে শনিবার দুপুর পর্যন্ত ৫০ পরিবারের লোকজন চলে গেছেন। এসব লোকজনের বেশিরভাগই শহরের রূপনগর ও শিমুলতলীর বাসিন্দা। এ ছাড়াও বাউবি কেন্দ্রের ৭৫ পরিবারের মধ্যে শনিবার দুপুর পর্যন্ত ৪৫ পরিবারের লোকজন চলে গেছেন বলে জানান, ওই কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায় মো. সাইফুল আলম। এভাবে দুর্বিষহ জীবনযাপন সইতে না পেরে সোমবার থেকে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তাদের কেউ ঝুঁকি নিয়ে ফিরছেন নিজেদের বসতভিটার বাড়ি আর কেউ গিয়ে উঠছেন আত্ময়-স্বজনের বাড়ি।
বিষয়টি স্বীকার করে জেলা প্রশাসক মো. মানজারুল মান্নান বলেন, অনেকে স্বেচ্ছায় গোপনে চলে যাচ্ছে আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে। পাহাড় ধসের পর ঝুঁকি তৈরি হওয়ায় নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হয়েছে তাদেরকে। পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত ওইসব বিধ্বস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ ভিটায় যেতে নিষেধও করা হয়েছে। এরপরও কেউ আদেশ অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ ফের দুর্যোগে আরও ক্ষয়ক্ষতি হলে সেই দায়ভার কে নেবে ?
শনিবার সরেজমিন বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, লোকজন চলে যাওয়ায় ফাঁকা হয়ে পড়ছে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো। দুর্গত অনেকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে এভাবে আর কতদিন ? ক্ষতি যা হবার হয়েছে, বাঁচতে তো লড়তেই হবে। মানবেতর পরিস্থিতিতে সরকার বা কারও আশায় হাত গুটিয়ে কীভাবে আর কতদিন বসে থাকা যায় ? তাই নিজেরার উদ্যোগে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর ঠিকঠাক করে সেখানে ঝুঁকিতে হলেও ফিরছেন তারা।
শনিবার দুপুরের দিকে পরিবার পরিজন নিয়ে রাঙামাটি সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়ছিলেন জয়নাল আবেদীন সর্দার (৬০)। ফিরছেন শহরের রূপনগরের নিজ ভিটায়। সঙ্গে আছেন স্ত্রী রিজিয়া বেগম (৫০), পুত্রবধূ পাখি বেগম (১৯) ও তার নবজাত কন্যাশিশু মারিয়া। জয়নাল আবেদীনের ছেলে (পাখির স্বামী) জসিম সর্দার (২৫) টিউবওয়েল নির্মাণ কাজে বাইরে গেছে বলে জানান তারা। ওই আশ্রয় কেন্দ্রেই কথা হয় এ পরিবারটির সঙ্গে।
পাখির শ্বাশুড়ি রিজিয়া বলেন, সদ্য প্রসূতি পুত্রবধূ ও নবজাত নাতনিকে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা খুব সমস্যা হচ্ছে। সেখানে প্রসূতি মায়ের ও নবজাতকের সেবাযতœ সম্ভব নয়। তা ছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রে শুধু দু’বেলা ভাত খেয়ে তো স্বাভাবিক জীবন চলে না। জীবন-সংসারে কতকিছুর প্রয়োজন। বাড়িঘর ছেড়ে এভাবে আর কতদিন থাকব ? তাই আমরা ভিটাবাড়ি ফিরে যাচ্ছি।
গৃহকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, আমাদের ভিটাবাড়ির আংশিক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু একেবারে ঝুঁকিতে পড়েছে। জান রক্ষায় ভিটাবাড়ি ছেড়ে ওঠেছি আশ্রয় কেন্দ্রে। এখানে দু’বেলা খাবার দেয়া হয়। অন্য খাবারও পাচ্ছিলাম। কিন্তু একেকটা পরিবারের সমস্যা ও প্রয়োজন অনেক। তার ওপর একটা জায়গায় এত পরিবারের লোকজনের গাদাগাদিতে পরিবেশ ও জীবনযাপন একেবারেই দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছে। সবচেয়ে কষ্ট নারীশিশুদের নিয়ে। তারা ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। জ্বর, সর্দি, কাশি, পেটের পীড়া লেগেই থাকে। তাই নিজের উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর ঠিকঠাক করে ঝুঁকিতে হলেও বসতভিটায় ফিরে যাচ্ছি।
একই এলাকার মো. নুরুল ইসলাম (৭০) বলেন, পাহাড় ধসে মাটির চাপায় বাড়িঘরসহ বসতভিটা বিলীন হয়ে এখন আর নিশানাটুকুই নেই। এজন্য বসতভিটায় ফেরার কোনো সুযোগ নেই তাদের। আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা খুবই কষ্ট। তাই স্ত্রী-সন্তান সবাইকে পাঠিয়েছেন শ্বশুড়বাড়ি। এখন একা পড়ে আছেন আশ্রয় কেন্দ্রে।
এদিকে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা পাহাড় ধসে গৃহহীন লোকজনকে স্থানান্তর করে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে জানান, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খোন্দকার ইখতিয়ার উদ্দিন আরাফাত। বর্তমানে ১৯ আশ্রয় কেন্দ্র গুটিয়ে ৪টিতে স্থানান্তর করে আশ্রিতদের সরিয়ে নেয়া হবে। এসব কেন্দ্র খোলা হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি কার্যালয়ে। এসব প্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাই ৬ জুলাইয়ের মধ্যে আশ্রিত পরিবারগুলোকে ৪টি কেন্দ্রে সরিয়ে স্থানান্তর করতে সরকারি সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তিনি জানান, যে চার স্থানে নেয়া হবে সেগুলো হল- রাঙামাটি স্টেডিয়ামের ড্রেসিং হল ও গ্যালারি কক্ষ, রাজবাড়ির কুমার সুমিত রায় জিমনেসিয়াম হলরুম, রাঙামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের অডিটোরিয়াম এবং রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস। ১৫ জুলাই পর্যন্ত ওই ৪টি কেন্দ্রে রাখা হবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আশ্রিত লোকজনকে। এরপর সেখান থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় বাড়িঘর নির্মাণ করে দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভেদভেদি দক্ষিণ মুসলিম পাড়ার শাহানা বেগম(৬২) তার মেয়েকে সাথে নিয়ে তার ভাঙ্গা ঘরে ফিরেছেন। একই ভাবে সরকারি কলেজ আশ্রয় কেন্দ্র হতে বাড়ি ফিরছেন র্নিমল ঘোষ তার স্ত্রী রিতারাণীসহ তার পরিবার।
ছবিরক্যাপশন-গতকাল শনিবার আশ্রয় কেন্দ্র থেকে নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন ভেদভেদি দক্ষিণ মুসলিম পাড়ার শাহানা বেগম ও তার মেয়ে ।
দৈনিক দেশজনতা/এন আর