দৈনিক দেশজনতা ডেস্ক:
ঈদে স্বপ্নকে বাড়ি নিয়ে যেতে চান অনেকেই। দেশের টানে, মাটির টানে শিকড়ের কাছে যাওয়ার প্রবল আকুতি একজন প্রবাসী কত দিন ধরেই না আগলে রাখেন। তিলে তিলে জমানো পয়সার ভাণ্ডার বার বার পরীক্ষা করেন- মাসের খরচপাতি বাদ দিয়ে আর কত ডলার যোগ করলে যাওয়া যাবে মায়ের কাছে, মাটির কাছে।এমন অন্তত তিন শতাধিক বাংলাদেশী যাত্রী যারা এতোদিন ধরে বিমানের টিকিট কেটে স্বপ্ন বুনেছেন দেশে ফিরবেন বলে, তাদের কান্না বেড়েছে নিউইয়র্কে। তবে এই সংখ্যা আরো কয়েকশ’ বেশি হতে পারে বলে অনুমান করছেন ভুক্তভোগীরা।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশি মালিকানায় সবচেয়ে বড় ট্রাভেল এজেন্সি বলে পরিচিত ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ট্রাভেলস’র মালিক তাদের কাছে বাজারমূল্যের চেয়ে অন্তত একশ ডলার কমে টিকিট বিক্রি করেছিলেন কয়েক মাস আগে। স্বত্বাধিকারী নাজমুল হুদা সেসব যাত্রীদের কান্না বাড়িয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন, বন্ধ করে দিয়েছেন তার চারটি ট্রাভেল এজেন্সির শাখা। আর নিজের কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে আবেদন জানিয়েছেন ফেডারেল বিভাগে।
স্বপ্নের জাল বুনে রাখা মানুষগুলো মায়ের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে ঈদ পালন করতে যেতে পারছেন না, এটিই নিউইয়র্কের বাঙালি পাড়ায় এখন সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়।
ছবিতে বাংলাদেশি আফতাব উদ্দীন খানকে দেখা যাচ্ছে তিনি তার টিকিট নিয়ে কমিউনিটি নেতা আবদুল হাসিম হাসনুকে দেখাচ্ছেন কোনো একটা উপায় খুঁজে বের করে দেয়ার জন্য। চারটি টিকিট কিনেছিলেন তিনি পরিবার নিয়ে দেশে যাবেন বলে। এই ঈদকে সামনে নিয়ে তার চোখে আনন্দ নয়, হতাশার কালোছায়া বিরাজ করছে।
ব্রঙ্কসের বাসিন্দা কাজী আবদুল অদুদ, সেবুল খান মাহবুবসহ আরো কয়েকটি পরিবার এখান থেকে টিকিট কেটে এখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। একজন বাংলাদেশীকে বিশ্বাস করাটাই কি তাদের অপরাধ ছিল!
এরই মধ্যে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ট্রাভেলস’র স্বত্বাধিকারী নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে ম্যানহাটান ফেডারেল কোর্টে প্রতরণার মামলা হয়েছে। আর জ্যাকসান হাইটের প্রিসিন্ট (এলাকা) এ বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকতার স্ত্রীও জানান, টিকিট কেটেছিলেন দেশে যাবেন পরিবারের সঙ্গে ঈদ করবেন বলে। এই টিকিট প্রতারণার পর ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অভিযুক্ত নাজমুল হুদা আমেরিকা ছেড়ে পালাতে পারবে না, তাকে এই প্রতারণা জবাব দিয়ে যেতে হবে।
তবে কোথায় আছেন নাজমুল হুদা সে সম্পর্কে কেউই অবগত নয়। নানা সংবাদমাধ্যমে পাঠানো তার ক্ষুদে বার্তায় তিনি বলার চেষ্টা করছেন, মৃদু স্ট্রোক করে তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। একটু সুস্থ হলেই তিনি ভোগান্তি নিরসনে কাজ করবেন।তিনি দাবি করেছেন, তার অসুস্থতার কারণে হয়তো ৩০/৪০ জন যাত্রীর সমস্যা হয়ে থাকতে পারে।
তার এই দাবি খণ্ডন করেছেন জ্যাকসান হাইটস বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জাকারিয়া মাসুদ জিকো। ‘আমার নিজের পত্রিকা আজকালেই অন্তত দেড়শ’ ভুক্তভোগীর নাম ছাপা হয়েছে। আমরা এ পর্যন্ত প্রায় তিন শতাধিক মানুষের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পেয়েছি’ এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন তিনি।
অন্যদিকে ব্রঙ্কস’র স্থানীয় কমিউনিটি সংগঠক, রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, ‘শুধু ব্রঙ্কস থেকেই আমার পরিচিত অন্তত ৪০ জন এই প্রতারণার শিকার। তাই তার দাবি যৌক্তিক নয়।’
জ্যাকসান হাইটস বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সভাপতি জাকারিয়া মাসুদ জিকো বলেন, যে সব অভিযোগ পাচ্ছি তার অনেকগুলোই বেশ হৃদয়স্পর্শী।তিনি বলেন, ‘একজন নারী তার স্বামী মারা গেছেন বলে তিনটি বাচ্চা নিয়ে দেশে যাওয়ার জন্য টিকিট কেটেছিলেন। কমিউনিটির অন্যান্য মানুষ গরিব ওই নারীকে চাঁদা তুলে টিকিট কেনার টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। ওই নারীর কান্না শুনলে কষ্ট লাগে।’এই প্রতারণাকে আমলে নিয়ে স্থানীয় বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন বেশ জোরেশোরেই মাঠে নেমেছে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফিরিয়ে দেয়ার উপায় বের করা নিয়ে। কারণ ভয়টা অন্য জায়গায়। এই ট্রাভেল ব্যবসার মার্কেট হাজার কোটি ডলারের। এই বিশাল সংখ্যক বাংলাদেশি যদি পরবর্তীতে ট্রাভেল টিকিট ক্রয়-বিক্রয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের প্রতি আস্থা হারায়, তাহলে এই মার্কেট চলে যাবে ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানিদের দখলে।
এটা হতে দেয়া যাবে না বলেই নিজ উদ্যোগে একটি হটলাইন চালু করে অনুরোধ জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তদেরকে অবিলম্বে যোগাযোগ করতে। ৯১৭৫১৭৯৭৭৭ এই নাম্বারে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়েছেন জাকারিয়া মাসুদ জিকো।
অভিযোগ রয়েছে, গত কয়েক মাস ধরে পত্রিকায় কম দাম টিকিট বিক্রির চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে টিকিট বিক্রি করেছে করেছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ট্রাভেলস এজেন্সি। তারা ক্রেডিট কার্ড বা অন্য পন্থায় টিকিট বিক্রি করেনি। ট্রাভেল কর্তৃপক্ষ কম দামে টিকিট দেয়ার প্রলোভনে নগদ টাকায় টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, অনেক দিন ধরেই তারা পরিকল্পনা করেই এটা করেছেন।
উল্লেখ, এবারই প্রথম নয়, এর আগে আরো দুজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এই টিকিট প্রতারণার ঘটনা ঘটিয়েছেন। দুই-তিন বছর আগে ফারহান নামের এক ব্যক্তি ফেয়ার স্কাই ট্রাভেল নামের প্রতিষ্ঠান দিয়ে এমনকি ওমরা হজের টিকিট মেরে দিয়ে চলে যান। এবার ঘটালো এতোদিন ধরে প্রবাসের সবচে বড় ট্রাভেল এজেন্টধারী ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ট্রাভেলস-এ। মানুষ তাই কাকে বিশ্বাস করবে, কাকে করবে না সেই দ্বিধায় পড়েছে।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ