২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৬:৪৯

রোজার আগেই সবকিছুর দাম বৃদ্ধি

নিজস্ব প্রতিবেদক

আমদানি ও মজুদ পর্যাপ্ত : সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চাল ডাল চিনি ছোলা পেঁয়াজ রসুনের দাম বেড়েছে : সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট অশেষ
শফিউল আলম : নিত্যপ্রয়েজনীয় খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের চাহিদা, আমদানি আর মজুদের মধ্যে ফারাক নেই। বরং চাল, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল, ছোলা, মটর, পেঁয়াজ-রসুন, শুকনো মরিচ, মসলাসহ অধিকাংশ পণ্যই চাহিদার তুলনায় সমান এমনকি কোনো কোনোটির বর্তমানে বাড়তি মজুদ রয়েছে। দোকান-পাট, পাইকারি আড়তে সবরকম নিত্যপণ্যে ঠাসা। অথচ মাহে রমজান ও শবেবরাত সামনে রেখে বাজারদর লাগামহীন হয়ে পড়েছে। এতে করে অসহায় সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। ক্রেতারা বাজারের আগুন দেখে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন, পরিবারে চাহিদার তালিকা কাটছাঁট করে কোনগুলো কেনা সম্ভব। খাদ্যসামগ্রী কিনতে গিয়েই আয়ের সিংহভাগ ফুরিয়ে যাচ্ছে অনেকেরই। রোজার আর বাকি মাত্র তিন সপ্তাহ, শবেবরাতের বাকি আর পাঁচ দিন। রোজার মাসজুড়ে ইফতারি ও সাহরির জন্য যেসব খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের চাহিদা বরাবরই সবচেয়ে বেশি, সেগুলোর দাম রমজানের আগেভাগে লাফিয়ে বাড়ছে। গতকাল (শুক্রবার) ও আদের দিনসহ (বৃহস্পতিবার) গত দু’দিন সরেজমিনে বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহে চাল, ডাল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ-রসুন, মরিচ, মসলার দাম ফের বেড়ে গেছে। শুধু ভোজ্যতেলের দাম আগের চড়া দরে হলেও মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। মাসখানেক আগেও বাজারের অগ্নিমূল্য সাধারণ মানুষকেও ভোগায়নি। তাছাড়া পাইকারি আর খুচরা দরদামেও গড়মিল দেখা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত এক-দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে উপরোক্ত পণ্যসামগ্রীর দাম কেজিপ্রতি ৪ টাকা থেকে ১৮ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
অন্যদিকে আমদানিকারক, মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা বর্তমানে বিশ্ববাজারে সবধরনের ভোগ্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল থাকার কথা স্বীকার করেও দাঁড় করাচ্ছে ভিন্ন অজুহাত। তারা বলছেন, বর্তমানে হঠাৎ করে ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় বিলম্বিত ঋণপত্রে (ডেফার্ড এলসি) মূল্য পরিশোধে আমদানি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাস্তবে বেশিরভাগ পণ্য আমদানি ও খালাস সম্পন্ন হয়েছে আগেই এবং লেনদেন হয় রেগুলার এলসিতে। চিটাগাং চেম্বার এবং খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, গত রমজানের চেয়ে এবার বেশির ভাগ নিত্যপণ্য ক্রেতারা কম দামে কিনতে পারবেন। আন্তর্জাতিক বাজারদর স্থিতিশীল থাকায় এবং চাহিদা অনুযায়ী আমদানি হওয়ায় এর সুফল মিলবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কোনো সংকট নেই। রোজার মাসের জন্য পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। বাজারে ক্রেতা সাধারণের কাছ থেকে কেউ যদি অযৌক্তিক বাড়তি মূল্য আদায়ের চেষ্টা করে তাহলে প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে বাজার মনিটরিংয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
চিনি সিন্ডিকেটের কারসাজি
অনুসন্ধানে জানা যায়, শবেবরাত ও রোজা সামনে রেখে যেখানে চিনির প্রচুর চাহিদা সেখানে, কারখানার কথিত ‘সংস্কারে’র নামে পরিকল্পিতভাবে গত দুই সপ্তাহের মধ্যে একে একে চিনির অধিকাংশ মিল বন্ধ রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির অপচেষ্টা চলছে। গতকাল পর্যন্ত শুধু চট্টগ্রামের একটি বড় শিল্প গ্রæপের চিনি পরিশোধন মিল চালু ছিল। মিলগেটে চিনির দর ছিল বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) গত ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ২৫শ’ টাকা। গত ২ মে থেকে বেড়ে উঠে ২ হাজার ৭৬০টাকা। সেই হিসাবে প্রতিকেজি দর পড়ে ৫৫ টাকা ২০ পয়সা। সারাদেশে এখন পাইকারি বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজি ৬০ টাকা, আর খুচরা ৬৫-৬৮ টাকায়। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, ব্যবসায়ী, ভোক্তাদের সভায় কেজিপ্রতি চিনির দাম দেশের বৃহত্তম পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং বাজার খাতুনগঞ্জে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা এবং খুচরা ৬২ থেকে ৬৩ টাকা দর বেঁধে দেয়া হয়েছে। যা গতকাল থেকে কার্যকর হয়েছে। তবে গ্রামেগঞ্জে কেজি ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গতবছরের বর্তমান সময়ের তুলনায় চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
দেশে চিনির চাহিদা ধরা হয় বছরে সাড়ে ১৩ লাখ মেট্রিক টন। তবে রোজায় চিনির চাহিদা প্রায় ৫০ হাজার টন বৃদ্ধি পায়। এ বছরের গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে ৬ লাখ ১৮ হাজার টন আমদানির অপরিশোধিত চিনি খালাস হয়। আগের ও বর্তমান আমদানি মিলিয়ে মজুদ থাকার কথা আড়াই লাখ টনেরও বেশি চিনি। এরমধ্যে অধিকাংশ চিনির শুল্কায়িত মূল্য পড়ে কেজি গড়ে ৩৬-৩৮ টাকা। অথচ আমদানিকারক, ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির স্থিতিশীল থাকলেও সম্প্রতি ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে বিলম্বিত ঋণপত্র (ডেফার্ড এলসি) খোলার ফলে এখন মূল্য পরিশোধের সময় দাম বৃদ্ধির অজুহাত দিচ্ছেন। সম্প্রতি এস আলম, মেঘনা গ্রæপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সুগার মিলের নামে ৪টি জাহাজযোগে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে।
ছোলা-ডালেও সিন্ডিকেট
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, দেশে চিনি, ছোলা, ডাল, ভোজ্যতেলসহ বেশকিছু বিশেষত রোজায় সর্বাধিক চাহিদার নিত্যপণ্য আমদানি ও বাজারজাত করে থাকে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, ইগলু গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বিএসএম গ্রæপ, দেশবন্ধু, এস আলম, পারটেক্স গ্রুপ (হাশেম কর্পোঃ)সহ শীর্ষ দশটি ব্যবসায়ীক গ্রæপ। আমদানির তথ্য-উপাত্তে েেদখা যাচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে গত জানুয়ারি-এপ্রিল ৪ মাসে ছোলা আমদানি করা হয়েছে প্রায় এক লাখ টন। যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৭৫ হাজার টন। আগের আমদানিসহ ছোলা মজুদ থাকার কথা অন্তত এক লাখ টন। রমজান মাসে দেশে ছোলার চাহিদা ধরা হয় ৮৫ হাজার টন।
এদিকে গতকাল পর্যন্ত দেশের খুচরা বাজারে ভাল মানের ছোলা বিক্রি হয়েছে কেজি ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। মাঝারি মানের ৭৫-৮০ টাকা। পাইকারি বাজারে ছোলা বিক্রি হচ্ছে কেজি ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। ছোলার দাম দু’সপ্তাহে বেড়েছে কেজিতে মানভেদে ১০-১৪ টাকা। ছোলার মূল্য আরও বৃদ্ধির তোড়জোড় চলছে। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে এখনও ৪০ হাজার টন ছোলা খালাস হচ্ছে। সেই ছোলা জেটি-ঘাট থেকেই সরাসরি (পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং) বিক্রি হচ্ছে কেজি গড়ে ৫০-৫৫ টাকায়।
গত ৪ মাসে মসুর ডাল আমদানি হয় ১ লাখ ৮৮ হাজার টন। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৫৮ হাজার টন। এবার মসুর ডালের মানভেদে আমদানি মূল্য পড়েছে কেজিপ্রতি ৬০ টাকা থেকে ৭৮ টাকা। অথচ খুচরা বাজারে ভাল মানের মসুর ডালের দাম কেজি ১৪৫ টাকা। তুরস্কের মসুর ৭৮ টাকা। গত দুই সপ্তাহে মসুর ডালের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে গেছে। গত ৪ মাসে মটর ডাল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার টন। গেল বছর একই সময়ে আনা হয় ৮৭ হাজার টন। আগের আমদানি জের থাকার কথা প্রায় এক লাখ টন। খুচরা বাজারে মটর বিক্রি হচ্ছে কেজি ৪০-৪৮ টাকায়। ইতোমধ্যে দাম বেড়েছে ৬ টাকা। ছোলার সাথে পাল্লা দিয়ে ছোলার ডালের দামও কেজিতে গড়ে ৮-১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১শ’ টাকা। মুগ ডালের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১শ’ থেকে ১৩০ টাকায়।
এদিকে খুচরা ও পাইকারি বাজারে এখনো ভোজ্যতেলের দাম (আগের চড়া দামে) স্থিতিশীল রয়েছে। খুচরা বাজারে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে লিটার (লুজ) ৮২ থেকে ৯০ টাকায়, এক লিটারের প্যাক ১০৫ টাকা, পাঁচ লিটারের প্যাক ব্রান্ডভেদে ৪৯০ টাকা থেকে ৫১৫ টাকায়। রমজানে ভোজ্যতেলের চাহিদা ধরা হয় সোয়া এক থেকে দেড় লাখ মেট্রিক টন। সারা বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ১৩ লাখ টন। রোজার চাহিদা সামনে রেখে গত চার মাসে ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে প্রায় ৫ লাখ টন। বর্তমানে আগের মজুদ থাকার কথা প্রায় এক লাখ টন। আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল থাকায় সয়াবিন তেল লিটার গড়ে ৮০-৮৪ টাকায় বিক্রি হলেও লাভ থাকার কথা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা আগের চড়া দর নামাতে নারাজ।
পাইকারি ও খুচরা বাজারে পেঁয়াজ ও রসুনের মূল্য বেড়েই চলেছে। খুচরায় আমদানি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকায়, দেশি পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। আমদানি ও দেশীয় রসুন মানভেদে কেজি ১শ’ থেকে ২৫০ টাকা, একদানার রসুন বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৩শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকায়। গত দুই সপ্তাহে পেঁয়াজ ও রসুনের দাম মানভেদে বেড়ে গেছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। আমদানি পেঁয়াজ ও রসুনে প্রায় ৩৪ ভাগ মুনাফা লুটছে সিন্ডিকেট। বাজারে শুকনো মরিচের দাম কেজিতে ইতোমধ্যে গড়ে ১০-১৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। আমদানিকৃত ও দেশীয় আদা মানভেদে বিক্রি হচ্ছে কেজি ৬০ থেকে ১১০ টাকা পর্যন্ত।
বেশ আগে থেকেই বাজারে সবধরনের চালের কিছু না কিছু মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অতিসাধারণ, গরিবের মোটা চাল (স্বর্ণা কিংবা চায়না ইরি) কেজি ৪২ থেকে ৪৬ টাকা দরে বিকিকিনি হচ্ছে। মধ্যবিত্তের পছন্দ মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি ৫২ থেকে ৫৮ টাকায়। পাইজাম চাল ৪৬ থেকে ৫২ টাকা। সাধারণ মাঝারি চাল কেজি গড়ে ৫০ টাকা। পাইকাররা জানান, গত দুই সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে গড়ে ৩ থেকে ১০ টাকা হারে ফের বেড়ে গেছে। চালের উপর আমদানি শুল্ক শূণ্যের পর্যায়ে নিতে বাধ্য করার জন্যই চালের সিন্ডিকেট এই মূল্যবৃদ্ধির কারসাজি করেছে। অথচ কোথাও চালের মজুদ ঘাটতি থাকার খবর পাওয়া যায়নি। চাল, ডাল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ-রসুন, মরিচ, মসলাসহ নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের ব্যবসার পেছনে একেকটি ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, মিল মালিক, আড়তদার সিন্ডিকেট নেপথ্যে সক্রিয় রয়েছে। পবিত্র রমজান মাস ও শবেবরাতকে পুঁজি করে ক্রেতাসাধারণের পকেট কেটে শত শত কোটি টাকা নির্ঘাত হাতিয়ে নেয়ার টার্গেট নিয়ে বাজার কব্জায় নেয়া ও নিয়ন্ত্রণের এসব নিত্যপণ্যের বাজারকে অস্থির করে তুলেছে অতি-মুনাফালোভী চক্রটি।
প্রকাশ :মে ৬, ২০১৭ ৪:০৬ অপরাহ্ণ