২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:২৮

করোনার প্রভাবে দেশে দেশে পুঁজিবাজারে ধস

করোনাভাইরাসের প্রভাবে একের পর এক পতন ঘটছে বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট কাঁপিয়ে সেই কম্পন লেগেছে উপমহাদেশের পুঁজিবাজারেও।  ভারত গত ১০ বছরের সর্বোচ্চ পতন দেখেছে গতকাল। পাকিস্তান বিরাট পতন ঠেকাতে লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশে গতকাল সাম্প্রতিক কালের সর্বোচ্চ পতন ঘটেছে মূল্যসূচকের। জাপান, হংকং, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশে বড় পতন ঘটছে।ভারতের সেনসেক্স প্রায় ১৯৪১.৬৭ পয়েন্ট পড়েছে; নিফটি পড়েছে ৫৩৮.০০ পয়েন্ট। বাংলাদেশের ডিএসইএক্স পড়েছে ২৭৯ পয়েন্ট বা ৬.৫১ শতাংশ,  সিএএসপিআই কমেছে ৭৬৯ পয়েন্ট। পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জের কেএসই-১০০ সূচকটি লেনদেনের অল্প সময়ের মধ্যে পড়ে যায় ২১০৬ পয়েন্ট। জাপানের নিকেই ২২৫ সূচক পড়েছে ১০০০ পয়েন্ট।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যের নানা খাতে ব্যবসা কমে গেছে। এই অবস্থা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি ভালো ব্যবসা করতে পারবে না ধারণা করে অনেকে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

তবে বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন ধরেই বাজার মন্দা যাচ্ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস আতঙ্ক। দেশি-বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়েছেন। ফলে শেয়ারবাজারে প্রায় শতভাগ কোম্পানির দরপতন হয়েছে গতকাল।

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে উদ্ভূত করোনাভাইরাস ইতিমধ্যে শতাধিক দেশে তার সংক্রমণ বিস্তার করেছে। সর্বশেষ গত রবিবার (৮ মার্চ) বাংলাদেশে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর রাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান সীমিত করার।

গত কয়েক দিনে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের বিস্তার ঘটায় এবং তারা বিভিন্ন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। ইতালিতে এক কোটির বেশি মানুষ কার্যত ‘কোয়ারেন্টাইনে’। দেশটি সিনেমা হল, পার্ক, জাদুঘরসহ বিভিন্ন জনসমাগমের মঞ্চ বন্ধ ঘোষণা করেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা-সংগঠন তাদের অনুষ্ঠান বাতিল করেছে। এসব নিয়েই বিশ্বের আর্থিক খাত বেকায়দায় বলে মন্তব্য করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার

গতকাল লেনদেন শুরুর প্রথম মিনিটেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ২৩ পয়েন্ট কমে যায়। দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর এই সূচকটি ২৭৯ পয়েন্ট বা ৬.৫১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৪০০৮ পয়েন্টে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ডিএসইএক্স সূচকটি চালুর পর গতকালই সর্বোচ্চ পতন হয়েছে। এটি এখন নেমে গেছে ভিত্তি পয়েন্টের নিচে। ওই সময় ডিএসইএক্স সূচকের ভিত্তি পয়েন্ট ছিল ৪ হাজার ৫৫ পয়েন্ট। আর ডিএস৩০ ছিল এক হাজার ৪৬০ পয়েন্ট।

গতকাল ডিএসইর অপর সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ৭০ পয়েন্ট, ডিএসই-৩০ সূচক ৮৯ পয়েন্ট এবং সিডিএসইটি সূচক ৫১ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯২৯, ১৩৪৬ ও ৭৯৬ পয়েন্টে।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, শুধু বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে পতন নয়, আমেরিকা, চীন, জাপান, ভারত, পাকিস্তান, হংকং, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশে বড় পতন ঘটছে।

আবু আহমেদ বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় বাজারে এক দিনে ২৮৯ পয়েন্ট কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সার্বিক অর্থনীতির সূচক  (রেমিটেন্স, রাজস্ব, রপ্তানি আয় ইত্যাদি) যদি আগামী তিন মাস খারাপের দিকে যায় তবে শেয়ারবাজারে প্রভাব পড়বে। তবে বিনিয়োগকারীদের ভয়ের কোনো কারণ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, শেয়ারের দাম আর কমার পর্যায়ে নেই। যারা ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন তারা কিছুদিন পর হলেও লাভবান হবেন।

ডিএসইতে গতকাল ৩৫৫টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২টির বা ০.৫৬ শতাংশের শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে। দর কমেছে ৩৫২টির বা ৯৯.১৫ শতাংশের এবং ১টি বা ০.২৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর অপরিবর্তিত রয়েছে।

এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জ্বা আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। আর এই কারণে পুঁজিবাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে।

পুঁজিবাজারের এই দরপতন কতটা যুক্তিসঙ্গত এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জ্জ্বা আজিজ বলেন, অনেক বিনিয়োগকারীর ধারণা করোনাভাইরাসের কারণে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসতে পারে। এতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি ভালো ব্যবসা করতে পারবে না। আর ব্যবসা করতে না পারলে তাদের লভ্যাংশ দেওয়ার পরিমাণও কমে যাবে। ফলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এটা দরপতনের একটা কারণ হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে অনেক বিনিয়োগকারী আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। আবার একই কারণে কোনো কোনো বিনিয়োগকারী নতুন করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। ফলে বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং ক্রেতা কম থাকায় পুঁজিবাজারে পতনের মাত্রা বেড়েছে।

অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই এদিন ৭৬৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৩২৯ পয়েন্টে। এদিন সিএসইতে হাত বদল হওয়া ২৫৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ৪টির, কমেছে ২৪৮টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৪টির দর।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘কারোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিশ্ব শেয়ারবাজারে দরপতন হয়েছে। পাকিস্তান শেয়ার মার্কেট বন্ধ করে দিয়েছে। গতকাল (রবিবার) করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হওয়ার পর মুজিববর্ষের প্রোগ্রাম পুনর্বিন্যাস করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।’

ভারতের শেয়ারবাজারে দশকের সবচেয়ে বড় পতন

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকার খবরে অস্থির হয়ে উঠেছে দেশটির পুঁজিবাজার। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক এই মন্দা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে ভারতীয় বাণিজ্যে।

গতকাল সোমবার টানা দ্বিতীয় দিনের মতো বড় দরপতন হয় এই বাজারে। লেনদেন শুরুর পর বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক সেনসেক্স এক ধাক্কায় ১৯৪১.৬৭ পয়েন্ট বা ৫.১৭ শতাংশ কমে যায়। এটি গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় পতন।

এনডিটিভির এক প্রতিবেদন জানায়, এদিন সেনসেক্স প্রায় ১৯৪১.৬৭ পয়েন্ট পড়ে দাঁড়ায় ৩৫,৬৩৪.৯৫ পয়েন্টে। আর নিফটি ৫৩৮.০০ পয়েন্ট পড়ে হয় ১০,৪৫১.৪৫।

এর আগে গত শুক্রবার সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে সেনসেক্স ১০০০ পয়েন্টের এশি কমে গিয়েছিল। ওই দরপতনে করোনা ভীতির পাশাপাশি ইয়েস ব্যাংক কেলেঙ্কারির বিষয়টিও প্রভাব ফেলে।

বাজার পতনের সঙ্গে সঙ্গে জোর ধাক্কা খায় ওএনজিসি, রিলায়্যান্স, বেদান্ত, ইন্ডাসইন্ড এবং টিসিএস-এর মতো সংস্থার শেয়ারগুলো।

পাকিস্তানে লেনদেন বন্ধ

করোনাভাইরাস আতঙ্কে গতকাল সোমবার লেনদেনের কয়েক মিনিটেই পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জের কেএসই-১০০ সূচকটি ২১০৬ পয়েন্ট কমে যায়। উদ্ভ‚ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ ৪৫ মিনিটের জন্য লেনদেন বন্ধ করে দেয়।

জিও টিভির খবর, সূচকটি আগের কার্যদিবস শেষে ৩৮২২০ পয়েন্টে ছিল। গতকাল লেনদেন শুরু হওয়ার পরপর ২১০৬ পয়েন্ট পতনের মাধ্যমে নিচের দিকে ধাবিত হয়। আরও পতনের আশঙ্কায় লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয় ৪৫ মিনিটের জন্য।

করোনাভাইরাস ভয় এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক মন্দায় পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জে এই পতন হয়েছে বলে জিও টিভির রিপোটে। এ ছাড়া সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যে অপরিশোধিত তেলের দামের টানাপোড়েনও এই পতনের একটি কারণ বলা হচ্ছে।

জাপানসহ এশিয়ার পুঁজিবাজার   

গতকাল ধস নামে এশিয়ার বিভিন্ন শেয়ারবাজারেও। সকালে বাজার খুলতেই জাপানের নিকেই ২২৫ সূচক পড়ে যায় ১ হাজার পয়েন্ট। অন্যদিকে, টপিক্স ৭৩ পয়েন্ট পড়ে হয় ১,৩৯৭.৭৭। একে একে ধস নামে হংকং, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়ার শেয়ারবাজারেও।

 

প্রকাশ :মার্চ ১০, ২০২০ ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ