নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদসহ পাঁচ দফা দাবিতে সারা দেশে ছাত্র ধর্মঘট পালন করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। গতকাল সোমবার সকাল থেকে ধর্মঘটের সমর্থনে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফটকে তালা দিয়ে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে জোটের নেতাকর্মীরা। তবে এদিনও প্রগতিশীলদের ওপর চড়াও ছিল ছাত্রলীগ। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে রাজশাহীতে কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও সিলেটে প্রগতিশীলদের ৭ নেতাকর্মী আহত হন। পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র ধর্মঘট পালন করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট।
এসময় তাদের সমর্থনে মাঠে ছিল নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীরাও। তবে ধর্মঘটে সমর্থন জানালেও মাঠে দেখা যায়নি বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন একাডেমিক ভবনের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয় প্রগতিশীলরা। এরপর ছাত্রজোট ও নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ধর্মঘটের সমর্থনে দফায় দফায় মিছিল করে। প্রগতিশীলরা কলা ভবন, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ভবন, কার্জন হল, মোকাররম ভবন ও এনেক্স ভবনসহ বিভিন্ন একাডেমিক ভবনের ফটকে তালা দেয়। ধর্মঘটের কারণে বেশকিছু বিভাগের ক্লাস বন্ধ ছিল। তবে পরীক্ষাসমূহ পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুপুর ১২টার দিকে কলা ভবনের মূল ফটকে প্রগতিশীলদের লাগানো তালা ভেঙে ফেলে কতিপয় যুবক। যারা নিজেদের ‘সচেতন শিক্ষার্থী’ বলে দাবি করে। আর সচেতন শিক্ষার্থীদের ব্যানারে গত কয়েকদিন যাবৎ আন্দোলন করে আসছে ছাত্রলীগ। দুপুরে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মিছিল পরবর্তী এক সমাবেশে প্রগতিশীল ছাত্র জোটের সমন্বয়ক ইমরান হাবিব রুমন অভিযোগ করেন ধর্মঘট সফল করতে গেলে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এসময় তিনি বলেন, সারা দেশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জোটের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করেছে। এখন থেকে কোথাও আঘাত করা হলে জোটের নেতারা তা প্রতিরোধ করবে। এসময় ইমরান হাবিব রুমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে করা তদন্ত কমিটি নিয়ে বলেন, তদন্ত কমিটির ১১ সদস্যের যখন ৮ জনই নিপীড়কদের পক্ষ নিয়ে শিক্ষক সমিতির মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করে, তখন এই তদন্ত কমিটির প্রতি কোনো আস্থা রাখা যায় না। তিনি বলেন, আমরা ১০ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তদন্ত কমিটি পর্যবেক্ষণ করব। এরপর আমরা নিজেরাই গণতদন্ত করে সেদিন কী ঘটেছিল তা জাতির সামনে তুলে ধরবো। ইমরান হাবিব রুমন জোটের পক্ষে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ৩১শে জানুয়ারি দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ মিছিল; ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দাবি পক্ষ ও ১৮ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান। এসময় উপস্থিত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি জিলানী শুভ, সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা, ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি নাইমা খালেদ মনিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির প্রমুখ।
তদন্ত কমিটিতে অনাস্থা নিপীড়ন বিরোধীদের
এর আগে মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে গত ১৫, ১৭ ও ২৩শে জানুয়ারির ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করা তিনটি তদন্ত কমিটির প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে বক্তব্য দেন নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ক মাসুদ আল মাহাদী। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির ১১ সদস্যের ৮ জনই গত রোববার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি আয়োজিত মানববন্ধনে উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের বিচার দাবি করেছেন। যা তাদের নিপীড়কদের পক্ষে অবস্থান এবং পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। তাই আমরা তদন্ত কমিটির ওপর আস্থা রাখতে পারি না। এসময় মাসুদ আল মাহদী প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানীর পদত্যাগ দাবি করে বলেন, দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ প্রক্টরকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। এসময় তিনি নিপীড়ন বিরোধীদের পক্ষে আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় প্রতিবাদ মিছিল ও প্রক্টরের কুশপুত্তলিকা দাহের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আর তাদের দাবি হচ্ছে ১৫ ও ২৩শে জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের ওপর যারা হামলা করেছিল তাদের বহিষ্কার করা।
রাবিতে ছাত্রজোটের কর্মসূচিতে হামলা
রাবি প্রতিনিধি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের অবস্থান ধর্মঘট চলাকালে তারা এ হামলার শিকার হন। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনায় ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা সোমবার সকাল ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থান নেন। ৮টা ১০ মিনিটে তারা ক্যাম্পাসের বাস আটকে দেয়। সকাল ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ও ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি মো. ইলিয়াস হোসেন ও ফিরোজ মাহমুদের নেতৃত্বে কয়েকজন নেতা সেখানে উপস্থিত হন। এ সময় তারা ছাত্রজোটের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িতে পড়েন। একপর্যায়ে তারা ছাত্রজোটের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় উভয়পক্ষে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশের সহায়তায় ছাত্রজোটের নেতাকর্মীদের সেখান থেকে সরিয়ে দিলে বাস চলাচল স্বাভাবিক হয়। দুপুর ১২টার দিকে ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। সমাবেশ থেকে তারা ঢাবিতে নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনে হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তির দাবি জানায়।
বিষয়টি জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, ‘তারা পরিবহনের বাস বন্ধ করে রেখেছিল। আমি তাদের বাস বন্ধের সহিংস রাজনীতি বাদ দিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করতে অনুরোধ জানাই। কিন্তু তারা সেটা মানেনি। এরপর আমাদের বাস বিকল্প রাস্তা দিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে যায়। পরে তারাও সেখান থেকে চলে যায়।’
চবিতে ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদককে ছাত্রলীগের মারধর
চবি প্রতিনিধি জানান, প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ব্যানারে ডাকা বাম ছাত্র সংগঠগুলোর ধর্মঘটে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদিকে ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসে প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করার অভিযোগে ছাত্রফ্রন্টের চবি শাখার সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিবকে মারধর করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
শাবিতে ছাত্রজোটের ধর্মঘটে ছাত্রলীগের হামলা, আহত ৭
শাবি প্রতিনিধি জানান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ব্যানারে চলা ধর্মঘটে হামলা চালিয়েছে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে অন্তত সাত জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ছাত্রজোটের নেতারা। এদিকে হামলাকারী ছাত্রলীগের কেউ নয় বলে দাবি করেছে শাবি ছাত্রলীগের সভাপতি রুহুল আমিন ও সাধারণ সম্পাদক ইমরান খান। ছাত্রজোটের নেতা তৌহীদুজ্জামান জুয়েল জানান, হামলায় জয়দ্বীপ দাস নামে ছাত্রফ্রন্টের এক কর্মীর মাথা ফেটে যায় এবং ছাত্রফ্রন্টের সিলেট নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রুবাইয়াৎ আহমেদ, ছাত্রজোটের কর্মী এমকে মুনিম, আব্দুল্লাহ হেল কাফী, মঈনদ্দীন মিয়া ও সুভাষ ঘোষ আহত হয়। জয়দ্বীপ দাসকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও ছাত্রীদের নিপীড়নের প্রতিবাদে গতকাল সকাল ৮টার দিকে ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসের বাস বন্ধ করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে সকাল ১০টার দিকে ক্যাম্পাস থেকে মিছিলসহ প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয় এবং অবস্থান নেয়। ১১টার দিকে ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা দেয়ার অভিযোগ তুলে শাখা ছাত্রলীগের নেতা মুশফিকুর রহমান জিয়ার নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের মারধর করে এবং প্রধান ফটক খুলে দেয়।
এদিকে শাবি প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হামলায় জড়িতদের নিজেদের সংগঠনের কেউ নয় দাবি করেছে ছাত্রলীগ সভাপতি রুহুল আমিন এবং সাধারণ সম্পাদক ইমরান খান। তারা হামলাকারীদের দুষ্কৃতিকারী বলে উল্লেখ করেন।
যোগাযোগ করা হলে মুশফিকুর রহমান জিয়া বলেন, ‘আমি একজন পরীক্ষিত ছাত্রলীগ কর্মী। আর বামপন্থিরা আমাকে ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা দিলে তখন আমি তাদের গেট খুলে দিতে অনুরোধ করি কিন্তু তারা উল্টো আমার ওপর চড়াও হয়। তখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে গেট খুলে দেই। এতে সাব্বির আহমেদ নামে ছাত্রলীগ কর্মী আহত হয়েছে।’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক জহির উদ্দিন আহমেদ ঘটনাটিকে খুবই দুঃখজনক বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। বিস্তারিত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ