নিজস্ব প্রতিবেদক:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকারে মঙ্গলবার এবং তার আগের গত দু’দিনে জালিয়াতির অভিযোগে মোট ১২ ভর্তিচ্ছুকে আটক করে পুলিশে দেওয়া হয়েছে। আটককৃতদের প্রায় সকলেই সাংবাদিকদের সামনে জালিয়াতি করে উত্তীর্ণ হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তারা জানান, বিভিন্ন মোটা অংকের টাকার চুক্তিতে তাদের হয়ে বদলি পরীক্ষা দিয়ে দেন জালিয়াত চক্রের সদস্যরা।
প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করার পর অনলাইন আবেদন ফরম জালিয়াত চক্রের সদস্যরাই পূরণ করে দেয়। আবেদন ফরম পূরণ করার সময় ভর্তিচ্ছুর সরবরাহকৃত ছবিটি এমন ভাবে ফটোশপ করা হয় যাতে আবেদনকারী ও বদলি পরীক্ষা দানকারীর চেহারার কিছুটা মিল থাকে। যাতে করে পরীক্ষার সময় পরীক্ষকরা চেহারার প্রার্থক্য ধরতে না পারেন।
টাকার চুক্তি করার পর সার্টিফিকেট সহ ভর্তির সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জালিয়াত চক্রের কাছে জমা রাখতে হয়। যাতে ভর্তি হওয়ার পর ভর্তিচ্ছু টাকা দিতে অস্বীকার না করেন। টাকা পরিশোধের পরই কেবল কাগজপত্র ফেরত দেওয়া হয়। এছাড়া প্রতারণা করলে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকিও দেওয়া হয়।
উত্তীর্ণ হওয়ার পর সাক্ষাৎকারে বদলি পরীক্ষাদানকারী ও ভর্তিচ্ছুর হাতের লেখার প্রার্থক্য যাতে ধরা না যায় সে জন্য সাক্ষাৎকারের কয়েকদিন আগ থেকে হাতের লেখার অনুশীলন করতে দেওয়া হয়। এভাবে পার পেয়ে যান অনেকেই। যারা হাতের লেখা আয়ত্তে আনতে পারেন না তাদের কেউ কেউ ধরা পড়েন ভাইভা বোর্ডের সদস্যদের হাতে।
এছাড়া ভর্তিচ্ছুকে প্রক্সিদানকারীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় না। যাতে করে সাক্ষাৎকারে ধরা পড়লে প্রক্সিদাতার নাম পরিচয় বলতে না পারেন ভর্তিচ্ছু।
তবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই টাকার বিনিময়ে প্রক্সি পরীক্ষা দেন বলে জানা গেছে। জাবির ভর্তি পরীক্ষার সময় প্রক্সি দেওয়ার অপরাধে তিনজনকে দণ্ড দেওয়া হয়। এদের মধ্যে একজন খুলনা প্রকৌশর ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের, একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ও অপরজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরীক্ষার সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক আবেদনকারীর এককপি করে প্রবেশপত্র প্রিন্ট করে। চেহারা মিলিয়ে দেখার জন্য পরীক্ষার কেন্দ্রে আবেদনকারীর ছবি ও অন্যান্য তথ্যের শিট কেন্দ্র পরিদর্শকদের সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এটি প্রিন্ট করা হয় সাদাকালো রঙে । যার ফলে ছবি ফটোশপ করা থাকলে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয় না।
এছাড়া অনেক কেন্দ্র পরিদর্শক প্রবেশপত্রের সাথে পরীক্ষার্থীর চেহারার মিল আছে কিনা তা সঠিকভাবে যাছাই করেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির পরিচালক সযোগী অধ্যাপক কে এম আক্কাছ আলীর সাথে। তিনি বলেন,‘প্রথমে আমাদের দোষটাই দেখতে হবে। পরীক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষকদের যে শিট দেওয়া হয় তাতে পরীক্ষার্থীদের ছবি থাকে। শিক্ষকরা সেগুলো ঠিকমত মিলিয়ে দেখেন না। আর বিশ্ববিদ্যালয় যে এডমিট কার্ডগুলো প্রিন্ট করে সেগুলো সাদাকালোতে প্রিন্ট করে। এতে চেহারার অমিল ঠিকমত ধরা যায় না।’
আক্কাছ আলী আরো বলেন, ‘আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম- আইআইটিতে একটা ছেলে প্রক্সির মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু উত্তরপত্রের হাতের লেখার সাথে তার হাতের লেখার কোন অমিল নেই। এভাবে কতজন যে ঢুকে গেছে কে জানে!’
সুপারিশ করে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এডমিট কার্ডের যে কপিগুলো প্রিন্ট করে সেগুলো রঙ্গিন প্রিন্ট করতে হবে। অনুষদগুলো তো অনেক টাকা আয় করে রঙ্গিন প্রিন্ট করতে সমস্যা কোথায়। রঙ্গিন প্রিন্ট করতে সমস্যা কোথায়? বেশি টাকা খরচ হবে বলে রঙ্গিন প্রিন্ট করা হয় না। আর পরীক্ষার্থীদের দুইটা এডমিট কার্ড নিয়ে আসতে বলতে হবে। একটা পরীক্ষার সময় উত্তর পত্রের সাথে নিয়ে নেওয়া হবে। আরেকটাতে পরিদর্শক হাতে স্বাক্ষর করে পরীক্ষার্থীকে দিবে যেটা পরীক্ষার্থীরা সাক্ষাৎকারের সাথে নিয়ে আসবে। কারণ এখন যে এডমিট কার্ড দেওয়া হয় তাতে ডীনের স্বাক্ষর থাকে। কিন্তু সেটা হাতে দেওয়া নয়। স্বাক্ষর ফটোশপের মাধ্যমে বসিয়ে দেওয়া যায়। আমরা আরও কিছু সুপারিশ প্রশাসনকে করব।’
কে এম আক্কাছ বলেন, ‘সবকিছু বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারবে না। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা যদি জালিয়াত চক্রের যারা মূলহোতা তাদেরকে নির্মূল করতে না পারে তাহলে এটা বন্ধ করা যাবে না। এরাই সবগুলো পাবলিক পরীক্ষায় জালিয়াতি করে।’