২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৩:৫৩

ধর্ষণে এক নম্বরে যুক্তরাষ্ট্র: চতুর্থ ভারত

দৈনিক দেশজনতা অনলাইন ডেস্ক:  

মেয়েদের জন্য বাংলাদেশ কতখানি নিরাপদ বা অনিরাপদ? কোনো পরিসংখ্যান না জেনেই আপনি হয়তো বলবেন, বাংলাদেশ সবচেয়ে অনিরাপদ। হ্যাঁ, বাংলাদেশেও ধর্ষণের মত ভয়াবহ অপরাধ ঘটছে। ধর্ষণের ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না। ধর্ষক গেপ্তার হচ্ছে, বিচার হচ্ছে, জেল থেকে বাইরেও চলে আসছে। কিন্তু আমরা সবাই সচেতন হলে, মনের এবং দেহের পশুত্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, ধর্ষণের ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনতে পারি। কারণ, অপরাধ-বিরোধিতার উপাদান আমাদের সমাজে, আমাদের মগজে ও মননে যথেষ্ট বিদ্যমান। এখনো সমাজে ভালো ও নিয়ন্ত্রিত মানুষের সংখ্যাই বেশি। তবে ধর্ষণ-বিহীন সমাজ নির্মাণ করা অসম্ভব না হলেও সহজ কাজ নয়।

যদি বলা হয়, ভারত এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বাংলাদেশের অবস্থা ভালো, তাহলে আমাদের মনোজগতের উপনিবেশ কি তাতে সায় দেবে? দেবে না। অনেকে হেসেই উড়িয়ে দেবে। কিন্তু বাস্তবতা আসলেই ভিন্ন। হতে পারি আমরা আর্থিকভাবে দরিদ্র, এরপরেও আইন-শৃঙ্খলা, শান্তি-অশান্তির বিচারে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ থেকে শহর হিসেবে ঢাকা কিংবা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো।

জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্ব ক্রাইম ট্রেন্ড রিপোর্টের ২০১৫ সালের ভার্সন থেকে জানা যায়, প্রতিবছর সবচেয়ে বেশী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১০টি দেশের তালিকায় এক নম্বর পজিশনে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর নাম্বার টেন পজিশনে আছে ইথিওপিয়া। পাশের দেশ ভারত ধর্ষণকাণ্ডে চতুর্থ স্থান ‘অর্জন’ করে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কাও ধর্ষণ অপরাধে বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তালিকায় ৯ নম্বর স্থানটি শ্রীলংকা। অষ্টম স্থানে আছে আরেক উন্নত রাষ্ট্র কানাডা, সাত নম্বরের রাষ্ট্রটির নাম ইউরোপের ফ্রান্স, ছ’য়ে আছে জার্মানি, পাঁচে যুক্তরাজ্য, চারে ভারত, তিনে সুইডেন, দুই এ সাউথ আফ্রিকা এবং এক নম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত নিয়ে একটু পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা যাক। নারীদের জন্য বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক রাষ্ট্র ভারত। ভারতে গাড়িতে, প্রকাশ্য রাস্তায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তথা যে কোনো স্থানে নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ভারতেরই জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর এক হিসেব থেকে জানা যায়, ২০১২ সালে ২৪,৯২৩টি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪, ৪৭০টি ঘটনায় ধর্ষকের ভূমিকায় ছিল বাবা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও অন্যান্য পরিচিত জন। অর্থাৎ প্রায় ৯৮ শতাংশ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে তাদেরই পরিচিত জন দ্বারা। সর্বশেষ প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ভারতে প্রতি ২২ মিনিটে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়।

কথায় কথায় বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশকে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সবক দেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধর্ষণ অপরাধে বিশ্বে এক নম্বর রাষ্ট্র। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারী স্বয়ং সেখানে ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এমন মার্কিন নাগরিকের মধ্যে ৯১ শতাংশ হচ্ছে নারী, বাকি ৯ শতাংশ হচ্ছে পুরুষ। আরও ভয়ের পরিসংখ্যান হল নিরানব্বই শতাংশ ধর্ষক হচ্ছে পুরুষ। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষ শুধু নারীকেই ধর্ষণ করছে তা নয়, তাদের হাতে পুরুষও ধর্ষিত হচ্ছে। আবার কিছু নারী আবার পুরুষকে ধর্ষণ করছে। ন্যাশনাল ভায়োলেন্স এগিয়েনস্ট উইমেন সার্ভে এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের প্রতি ৬ জনের একজন এবং পুরুষদের প্রতি ৩৩ জনের একজন জীবনে একবার হলেও ধর্ষণের পূর্ণ কিংবা আংশিক শিকার হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২৫ শতাংশ নারী রিপোর্ট করেছে যে, তাদেরকে ১৪ বছর বয়সের আগেই ধর্ষণ করা হয়েছে অথবা ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন। তবে সব ঘটনার মাত্র ১৬ শতাংশ রেকর্ড করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্ষণের বেশীরভাগ ঘটনা ঘটেছে ভিকটিমদের ঘর-বাড়িতেই।

তুলনামূলক পুরনো পরিসংখ্যান দিয়েও আমরা ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি রাষ্ট্রে অপরাধ প্রবণতার চিত্র অনুধাবন করতে পারি। ২০১০ সালের জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বিশ্বের প্রথম ১০ টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল তৃতীয়। অন্যদিকে মানুষ হত্যার সংখ্যার বিচারে ২০১২ সালের এক হিসেবে ভারতের অবস্থান দ্বিতীয় বলে জানা যায়। অপরাধ প্রবণতা বিষয়ক জাতিসংঘের সে জরিপে বলা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১০ সালে ৮৫,৫৯৩টি ধর্ষণ মামলা রেকর্ড করা হয়। অন্যদিকে ব্রাজিলে রেকর্ড হয় ৪১,১৮০টি। এদিকে সে বছর ভারতে ধর্ষণ মামলা রেকর্ড হয় মত ২২,১৭২ টি। জাতিসংঘের সরবরাহকৃত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ২৭.৩ শতাংশ। ব্রাজিলে এর হার প্রতি লাখে ২১.০৯ শতাংশ এবং ভারতে ১.৮ শতাংশ।

যুক্তরাজ্যের ধর্ষণ-পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যে ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ১৫,৮৯২টি; প্রতি লাখে এর হার ২৮.৮ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী মেক্সিকোতে ২০১০ সালে ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ১৪,৯৯৩টি, প্রতি লাখের হিসেবে যার হার ১৩.২ শতাংশ।ইউরোপের রাষ্ট্র ফ্রান্সে সে বছর ১০,১০৮টি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে, প্রতি লাখের হিসেবে যার হার ১৬.২ শতাংশ। জার্মানিতে এক বছরে ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ৭,৭২৪টি, সুইডেনে ৫,৯৬০টি (প্রতি লাখের হিসেবে ৬৩.৫ শতাংশ), রাশিয়াতে ৪,৯০৭টি, ফিলিপাইনে ৪,৭,১৮টি এবং কলম্বিয়াতে ৩,১৫৭টি। ধর্ষণ ছাড়াও খুনের হিসেব করেও জাতিসংঘ নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। ২০১৩ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে সবচেয়ে বেশী মার্ডার হয়েছে ব্রাজিলে (৫০,১০৮টি)। খুনাখুনিতে ব্রাজিলের পরেই আছে ভারত (৪৩,৩৩৫টি)। নাইজেরিয়াতে সে বছর মার্ডারের সংখ্যা রেকর্ড করা হয় ৩৩, ৮১৭ টি, মেক্সিকোতে ২৬,০৩৭টি, কঙ্গোতে ১৮,৫৮৬টি, সাউথ আফ্রিকাতে ১৬,২৫৯টি, কলম্বিয়ায় ১৪,৬৭০টি এবং পাকিস্তানে ১৩,৮৪৬টি।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান অধিক গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করলাম। কারণ এ দুটি রাষ্ট্র নিয়ে বাংলাদেশের সমাজে নানা ধরনের আলোচনা রয়েছে। মানুষের মনে নিজের দেশ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারনা আছে। দেশি-বিদেশী গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত নিয়মিতভাবে শুধু নেতিবাচক সংবাদ প্রচারের ফলে মানুষের, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। বিদেশী সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের নেতিবাচক সংবাদ নিয়ে যত আন্তরিক, নিজেদের মালিক রাষ্ট্রের সংবাদ নিয়ে ঠিক ততটাই উদাসীন। যাইহোক, বাংলাদেশের পরিস্থিতিটাও জেনে নেয়া যাক।

লন্ডন-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ‘নারীদের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলছে বাংলাদেশে ২০১৬ সালে এক হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নামের সংগঠনটি নারীদের উপর নির্যাতনের ‘নির্মম ও নিষ্ঠুর’ ধরণকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে বর্ণনা করেছে। বাংলাদেশের ১৪ টি দৈনিক পত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে সংগঠনটি বলছে ২০১৬ সালে ১০৫০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তারা বলছে, আগের বছরের তুলনায় এই সংখ্যা কিছুটা কম হলেও ধর্ষণ, নির্যাতনের ধরণ ছিলো নির্মম ও নিষ্ঠুর। এ ঘটনাগুলোকে ‘ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা’ এই তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে।

নারী ও কন্যা শিশুদের উপর নির্যাতনের বাৎসরিক এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, আগের বছরের তুলনায় সংখ্যা কিছুটা কমেছে, তবে সংগঠনটির সভাপতি আয়েশা খানম বলছিলেন সংখ্যা কম বেশির চেয়ে বেশি উদ্বেগের ছিল নির্যাতনের ধরণ ও মাত্রা নিয়ে। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা নতুন নয়, তবে সাম্পতিক সময়ে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও। পত্রিকায় উল্লেখিত ঘটনাগুলোর অনুসন্ধান করতে যেয়ে মহিলা পরিষদ বলছে, অনেক গুলো ঘটনার ক্ষেত্রে এলাকাবাসীরা অভিযুক্তকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। এর আগে বেসরকারি একটি পরিসংখ্যান বলা হয়েছিল বাংলাদেশে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩০০-র বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সম্প্রতি শিশু ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল। আর বরাবরের মতই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে দায়ী করেছিল অনেকে’।

বিবিসির এই প্রতিবেদন থেকে এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা খুবই উদ্বেগময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। কঠোর আইন, সামাজিক বিধি-নিষেধ, ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে ধর্ষণকে প্রতিরোধ করতে হবে। প্রয়োজনে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণিত হলে সে নারী বা পুরুষের ফাঁসির ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশের নীতি নির্ধারকদের পক্ষ থেকে আইনি সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।

দৈনিকদেশজনতা/ আই সি

প্রকাশ :অক্টোবর ২৮, ২০১৭ ২:১৭ অপরাহ্ণ