২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৭:৫৭

কপোতাক্ষ পাড়ের আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র

শিল্পসাহিত্য ডেস্ক:

সিংহ রাশির জাতক আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্রের জন্ম ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট। সেই হিসেবে বিশ্বকবির  সঙ্গে সঙ্গে তারও ১৫০তম বা সার্ধশত বর্ষ পূর্ণ হয়েছে গত বছর। প্রফুল্ল চন্দ্র বলতেন আমি ঘটনাচক্রে রসায়নবিদ- Chemist by accident. এটা তার চিরাচরিত রসবোধের প্রকাশ হতে পারে। হতে পারে তার অন্য কিছু হওয়ার বাসনা ছিল; হয়ত চেষ্টাও ছিল। কিন্তু তারপরেও একথা মানতে হয় এই দুর্ঘটনাটি না ঘটলে একটা বড় শূন্যতা থেকে যেত বাঙালির বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে।

একথা রবীন্দ্রনাথের মতো সকলেই স্বীকার করবেন একসঙ্গে। বিজ্ঞানের ধ্রুপদ তত্ত্বীয় জ্ঞান অনুশীলনে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে তার বাস্তব চর্চা করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন শিল্প প্রতিষ্ঠান বিখ্যাত বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কস তারই স্বপ্নের ফসল।

আচার্য্যের প্রথম স্বপ্ন ছিলো বোধকরি লেখক হওয়া। সারাজীবন লিখেছেন প্রচুর; তার জীবনী লেখা বা বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা অথবা ভারতের অর্থনীতি সমাজনীতি নিয়ে লেখা সবখানেই তার ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা এক সাহিত্যিককে সহজেই চিনিয়ে দেয়।

অনেকে বলেন তার চেয়ে মাস তিনেকের বড় রবিঠাকুর যখন সাহিত্যভুবন শাসন করছেন তখন কি আর সাহিত্যচর্চা করে প্রফুল্ল চন্দ্র সাড়া ফেলতে পারতেন?

এ তর্ক নেহাতই ধারণা প্রসূত বা হাইপোথিটিক্যাল তবে আচার্য্যের মধ্যে যে যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ভাবচি স্বামী শ্রদ্ধানন্দের মতো শুদ্ধির কাজে লাগব, যেসব জন্ম সাহিত্যিক গোলমালে ল্যাবরেটরির মধ্যে ঢুকে পড়ে জাত খুইয়ে বৈজ্ঞানিকের হাটে হারিয়ে গিয়েছেন তাদের ফের জাতে তুলব। আমার এক একবার সন্দেহ হয় আপনিও বা সেই দলের একজন হবেন…।’

বিজ্ঞান চর্চা করতে গেলে ‘জাত খোয়ানোর’ একটা ভয় বাঙালিদের সবসময় ভর করে থাকত। আচার্য্য বুঝে ছিলেন এই ভূতের ভয় দূর করতে না পারলে বাঙালিকে বিজ্ঞানমনস্ক করা যাবে না। ছাত্রদের মনের মধ্যে যুক্তি আর বিজ্ঞানের বীজ বুনে দেয়ার কত না কৌশল জানা ছিল খুলনার কপোতাক্ষ পাড়ের রারুলি-কাটিপাড়া গ্রামের এই সরল মানুষটির।

ক্লাসে রসায়ন পরীক্ষা করে দেখাতে দেখাতে একটা হাড়ের অংশ বুনসেন বার্নারে গরম করে দেখাতেন তা নিতান্তই ক্যালসিয়াম অক্সাইড। তারপরই সবাইকে চমক দিয়ে পরিবর্তিত ক্যালসিয়াম অক্সাইডটা টুপ করে মুখে পুরে দিতেন।

ছাত্রদের চমক জাত যাওয়ার আতঙ্কে পরিণত হতে দেখে সকলকে বুঝিয়ে বলতেন হাড় গরুরই হোক বা কালো হরিণেরই(মতান্তরে শূকর) হোক এখন তা শুধু ক্যালসিয়াম অক্সাইড। অনেক ছাত্র বিষয়টা বুঝে নিলেও সবাই যে মেনে নিতেন তা বলা যাবে না।

আচার্য্য সেটা বুঝেছিলেন কিন্তু হাল ছাড়েননি। নিজের ব্যর্থতার কথা লিখেছেন অকপটে তার সত্যের সন্ধান প্রবন্ধে- ‘…বৈজ্ঞানিক সত্যের ব্যাখ্যা করিয়ে বুঝাইয়া আসিলাম, তাহারাও বেশ বুঝিল এবং মানিয়া লইল, কিন্তু গ্রহণের (সূর্যগ্রহণ/চন্দ্রগ্রহণ) দিন যেই ঘরে ঘরে শঙ্খ-ঘণ্টা বাজিয়া উঠে এবং খোল করতাল সহযোগে দল দলে কীর্তনীয়ারা রাস্তায় মিছিল বের করে, অমনি এই সকল সত্যের পূজারীরাও সকল শিক্ষাদীক্ষা জলাঞ্জলি দিয়া দলে দলে ভিড়তে আরম্ভ করে, এবং ঘরে ঘরে অশৌচান্তের মতো হাড়িকুড়ি ফেলার ধুম লাগিয়া যায়।’

অনেকের মাঝে থেকেও বড় একা ছিলেন বলেই বোধ হয় ভালো বেহালা বাজাতে পারতেন তিনি! বাংলা ইংরেজি ছাড়াও আরবি, ফার্সি আর সংস্কৃতি ভাষায় তার জ্ঞান ছিল হিংসা করার মতো। আরব রসায়নবিদের মূল রচনা তিনি পড়েছিলেন আরবিতে। অনুবাদে তার জ্ঞানপিপাসা মেটেনি। ‘হিষ্ট্রি অব হিন্দু কেমেষ্ট্রি’ লিখতে গিয়ে সনাতন ধর্মগ্রন্থগুলো মন দিয়ে পড়তে হয়েছিল মূল ভাষায়।

বেদান্তে দর্শনকে তিনি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন। বলেছেন, ‘বিজ্ঞান চর্চার একটা প্রাথমিক শর্ত হলো, আশেপাশের বস্তুগত সম্বন্ধে একটা কৌতুহল। যদি কেউ মনে করে যে, বস্তুজগতটাই মায়া বা ভ্রম মাত্র, তাহলে তার আর কৌতূহল থাকবে কেন? জানতে চেষ্টাই বা সে করবে কেন?’ তিনি জানতেন মায়াবাদী দর্শনের প্রভাব বিস্তার বন্ধ করতে না পারলে বিজ্ঞান চর্চার প্রসার ঘটবে না।

আচার্য্যের লেখাপড়া শুরু তার বাবার প্রতিষ্ঠিত গ্রামের স্কুলেই- রারুলীর সে স্কুল এখনো আছে তবে সেখান থেকে আগামীর আচার্য্যরা কতদূর আসতে পারবেন তা বলা কঠিন। গ্রামের স্কুল থেকে কলকাতায় পড়তে গিয়ে বাঙ্গাল প্রফুল্লকে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। ক্লাসের সবাই তাকে ভাবত ছিড়িহীন(শ্রীহীন) এক উঠকো বাঙ্গাল। বাঙ্গাল বলেই তাকে ডাকত। সে বড় কষ্টের সময় ছিল আচার্য্যের।

শহর কলকাতার কলের পানি, মাটির নীচের ড্রেন এসব তার ভালো লাগলেও মানুষগুলোকে ঠিক বুঝাতে পারছিলেন না। এর মধ্যেই মহা-আমাশয় আক্রান্ত হলে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে তাকে আবার চলে আসতে হয় রারুলীর বাড়িতে। টানা দু’বছর লাগে তার সুস্থ হতে। কিন্তু এ দু’বছর প্রফুল্ল পরিণত হন বইয়ের পোকায়। ইংরেজি সাহিত্যের ধ্রুপদ লেখা, প্রাচীন বাংলা পুঁথি, এমনকি গ্রিক আর ল্যাটিনের পাঠও নিয়ে ফেলেন এ দু’বছরে।

বাড়ির পুরনো দেরাজের রাখা কোনো বই পড়া তার বাকি থাকেনি। পিতামহ আর প্রপিতামহের বৈভবের অলঙ্কার হিসাবে যত বই জমা ছিল তা বোধ হয় তিনি একাই পড়েছিলেন। পিতামহ আর প্রপিতামহের কাছে এ ব্যাপারে তিনি  ঋণী থাকলেও ঋত্বিক এই পুরুষ তার পূর্বপুরুষদের অবৈধ রোজগারের কথা অকপটে লিখেছেন নিজের বইয়ে।

বাবার বড় শখ ছিল অন্তত একটা ছেলেকে তিনি বিলাতে পাঠাবেন। ততদিনে যশোর খুলনা অঞ্চলের অনেকে বিলেত গেছেন। সাগরদাড়ির দত্তবাড়ির ছেলে মধু বিলেতি সাহেব হয়েছে। রূপসার পিঠাভোগ গ্রামের কুশারীরা জোড়াসাঁকোর ঠাকুর হয়েছে। তাদের ছেলেপুলে আর জামাইদের বিলাতে পাঠাচ্ছে বছর বছর। কিন্তু সেদিন আর নেই পিতা হরিশ্চন্দ্রের; কৃষ্ণনগর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে কলকাতায় চলে এলেও ‘নামেই তালপুকুর ঘটি ডোবে না।’

তবে প্রফুল্ল ঠিক করেন তিনি বাবার এই আশাটা অন্তত পূরণ করবেন। পরীক্ষা দেন গিলক্রিস্ট স্কলারশিপের জন্য এডেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই প্রথম কোনো ভারতীয় লাভ করে গিলক্রিস্ট ফেলোশিপ। প্রফুল্লের সঙ্গে আরেকজন ছিলেন মহারাষ্ট্রের এক বাহাদুরজি। তখন কমপক্ষে চারটি ভাষায় জ্ঞান না থাকলে এই স্কলারশিপের জন্য আবেদনই করা যেত না। সহপাঠীরা ভ্রুকুঁচকে ছিল প্রফুল্লের সাধ দেখে, কেউ কেউ বলেছিল ‘বাঙ্গালের সাধ কত?’

কিন্তু সে সাধ পূরণ হয়েছিল। আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বসু তখন কেমব্রিজ জাঁকিয়ে বসেছেন। বিক্রমপুরের এই বাঙ্গাল জাহাজঘাটে এসে প্রফুল্লকে বরণ করেছিলেন। মাকে খুব ভালোবাসতেন প্রফুল্ল, বোধ হয় সব থেকে বেশি ভালোবাসতেন তাঁকে। বিদায় নিতে গ্রামের বাড়ি এসেছিলেন রারুলীতে। বিদায়ের সময় মার চোখের পানি থামে না, যেন বয়ে চলেছে কপোতাক্ষী।

দাদা, পরদাদাদের জমি-জিরাত তখন একে একে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। মাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে এ সময় বলেছিলেন মা তুমি কেঁদো না আমি যদি প্রতিষ্ঠিত হতে পারি তাহলে দেখো একদিন আমাদের হারিয়ে যাওয়া সব সম্পত্তি ফিরিয়ে আনব আবার আদিগন্ত হবে আমাদের বাড়ির সীমানা।

এই প্রতিশ্রুতি তিনি রাখেননি নিজেই লিখেছেন, ‘আমি স্বীকার করি যে আমার মনের আদর্শ তদানীন্তন সামাজিক আবহাওয়ার প্রভাবে সংকীর্ণ ছিল। বিধাতা অন্যরূপ ব্যবস্থা এবং পরবর্তী জীবনে আমি এই শিক্ষাই লাভ করিলাম যে ভূসম্পত্তিতে আবদ্ধ রাখা অপেক্ষা উপার্জিত অর্থ ব্যয় করিবার নানা উৎকৃষ্ট উপায় আছে।’

আমরা জানি আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র দেশের আর দশের সেবায় নিজের সর্বস্ব দান করেছেন। বেছে নিয়েছিলেন এক সন্ন্যাসীর জীবন। ছাত্রদের সঙ্গে থাকতেন এক বাড়িতে। ‘বাঙ্গালদের জন্য কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, ঘটিদের জন্যও দান করেছেন দু’হাতে। তার কাছে ঘটি, বাঙ্গাল, হিন্দু, মুসলমান, মুচি, ডোম কোনো পার্থক্য ছিল না। পার্থক্য করলাম আমরা, তাকে ভুলে গেলাম তার সার্ধশত বর্ষে। এ ভুলের মাশুল কে গুণবে?

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রকাশ :অক্টোবর ১২, ২০১৭ ৬:০৯ অপরাহ্ণ