নিজস্ব প্রতিবেদক:
তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মিরা খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। এতে প্রাণ যাচ্ছে দলের নিরীহ নেতা-কর্র্মি। গত ৩ বছরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয়েছে ৭ নেতা-কর্মি। জেলার নেতারা উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড নেতাদের বারবার সতর্ক করলেও কেউ কারো কথা শুনছেন না। জড়িয়ে পড়ছেন প্রাণঘাতি সংঘর্ষে। হত্যাকান্ডের পর মামলায় আসামীও হচ্ছে দলেরই লোকজন। আর একের পর এক ঘটনা ঘটে চললেও এটা নিরসনে তেমন কোন উদ্যোগ নেই বলে মনে করেছেন তৃণমূল কর্মিরা। আধিপত্য বিস্তার, সামাজিক বিরোধ ও ভাগ বাটোয়ারা নিয়েই এসব হত্যাকান্ড ঘটছে বলে মনে করেন বেশির ভাগ নেতা।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিগত কয়েক বছরে কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন কোন্দল বেড়েছে। আর এসব কোন্দল রূপ নিচ্ছে সংঘর্ষে। সর্বশেষ গত ১৮ জুন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা বাজারে দিনে দুপুরে শাহাবুদ্দিন আহমেদ শাহিন নামের এক যুবক খুন হয়। একটিপক্ষ তাকে যুবলীগ কর্মী দাবী করে লাশ নিয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে। ওই ঘটনায় শাহিনের পিতা শাহার আলীকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে তারা। শাহার আলী পঁচাত্তর পরবর্তি সময়ে আমলা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন।
মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন এবং আমলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা আনোয়ারুল মালিথার মধ্যে বিরোধ থেকে এ খুন হয়। ওই খুনের মামলায় কামারুল আরেফিনসহ দলেরই প্রায় ৬০ জনকে আসামী করে মামলা হয়েছে। বর্তমানে জেলে আছেন কামারুল আরেফিন। অন্যরা পলাতক। আবার এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে আওয়ামীলীগ নামধারী কিছু নেতা। তারা মামলার আসামী আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীদের বাড়ীতে তছরূপ করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এর আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলা জিয়ারখীতে খুন হন ইদ্রিস আলী নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মি। জিয়ারখী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুল কাদের ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আফজালের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। সংঘের্ষ প্রাণ যায় ইদ্রিসের। এ ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মিদের নামে।
চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি মিরপুর উপজেলার আমবাড়িয়ায় দিনে দুপুরে খুন হন সদ্য আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া লুৎফর রহমান সাবু। তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার জের ধরে আমবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা জাসদের সহ-সভাপতি মশিউর রহমান মিলনের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ কর্মিরা। সাবু হত্যা আসামী হন জাসদের নেতা-কর্মিরা। আর জাসদ অফিসে ভাংচুরের মামলায় আসামী হন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারন সম্পাদকসহ বহু নেতা-কর্মি।
২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল ইউপি নির্বাচনে সদর উপজেলার দহকুলা ইউনিয়নের দহকুলা গ্রামে খুন হন আওয়ামী লীগ কর্মি লাল্টু মোল্লা। নির্বাচন ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক তৎকালীন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান বিশ্বাসের সাথে বর্তমান চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিনের সাথে বিরোধ চলে আসছিল। লাল্টুসহ তার পরিবার সিরাজকে সমর্থন করায় দিনে দুপুরে বাড়ির বারান্দায় কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা এক সন্তানের জনক লাল্টুকে। এ ঘটনায় মামলায় হয় আক্তারুজ্জামান বিশ্বাসসহ তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে। দল থেকে তাকে বহিস্কারও করা হয়।
এদিকে গত বছর ইউপি নির্বাচনের পর সদর উপজেলার ঝাউদিয়া ইউনিয়নে দুই আওয়ামী লীগ নেতার বিরোধে প্রাণ যায় তিন নিরীহ কর্র্মির। নির্বাচনী জয়ী হয়ে কেরামত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মিদের বাড়ি ঘরে হামলা চালিয়ে মারধর করেন। পরে ২৮ সেপ্টেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান কেরামত আলী এবং পরাজিত সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউপি আওয়ামী লীগ সভাপতি বখতিয়ারের সমর্থকরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন ইমান আলী নামের এক ব্যক্তি। পরে মারা যান শাহাবুদ্দিসহ আরো একজন। মামলা হয় বখতিয়ারসহ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মিদের নামে।
এর আগে ২০১৫ সালের ১৫ আগষ্ট শোক দিবসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর গেটে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবকলীগের নেতা-কর্মিরা। সবুজ নামের এক যুবলীগ কর্মিকে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। আসামী হন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকসহ বহু নেতা-কর্মি। সবুজ হত্যা মামলার প্রধান আসামী কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারন সম্পাদক ও চেম্বারের সহ-সভাপতি শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজ গত ২ বছর ধরে নিখোঁজ আছে। র্যাব পরিচয়ে আটকের পর তার আর কোন খোঁজ মেলেনি।
এসব বিষয়ে কথা হলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আজগর আলী বলেন, গত কয়েক বছরে দলে বিএনপি থেকে অনেকে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা ফায়দা লুুটতে আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবহার করছে। আর দলের নেতারা বুঝে হোক আর না বুঝে হোক তাদের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেরায় মারামারি করে মরছে। আর কিছু সুবিধাবাদি নেতাও নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে নানা অপকর্ম করছে। এদের ব্যাপারে দলের নেতাদের সাবধান থাকতে হবে।
এদিকে সম্প্রতি একের পর এক নিহত হওয়ার ঘটনায় দলের শীর্ষ নেতারা উদ্বিগ্ন। তারাও বিষয়টি সমাধানের জন্য চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে জিয়ারখীসহ কয়েকটি এলাকার নেতাদের মধ্যে চলে আসা দ্বন্দ্ব নিরসনে মিটিংও হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সদর এমপি মাহবুব উল আলম হানিফ নিজে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে যে সব নেতা-কর্মীরা তাদের মাশুল গুনতে হবে বলে হুশিয়ার করে দিয়ে ভাল হয়ে সবাইকে এক সাথে দলের জন্য কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ