৩০শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | রাত ৩:৩০

নতুন সড়ক আইন কতটা কার্যকর হবে?

সড়কে চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠিন সাজার বিধান রেখে কার্যকর করা হয়েছে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’। ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া আইনটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হলেও এর প্রয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক উঠেছে ইতিমধ্যে। আইন চালুর আগে আগে কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা ও সতর্কতা করা হয়নি। একই সঙ্গে জরিমানার পরিমাণকে বেশি বলছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। আর পথচারীদের যত্রতত্র রাস্তা পারাপারের যে পরিমাণ জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে তাকে অস্বাভাবিক বলছেন অনেকে।

কোনো ধরনের সচেতনতা কিংবা প্রচারণা ছাড়াই আইন প্রয়োগ করতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাতে আইন যথাযথ কার্যকর করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।

তবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল জানিয়েছেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করা হলেও এখনই শাস্তি প্রয়োগ হচ্ছে না। সারা দেশ সচেতনতামূলক প্রচারণার চালানোর জন্য আগামী এক সপ্তাহ নতুন আইনে কোনো মামলা হবে না।

এদিকে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শাস্তি বাড়ানোর বিরোধিতা করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান নতুন এই আইন নমনীয় করার দাবি জানিয়েছেন।

গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলা শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হওয়ার ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নামে শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন আইন পাস করে সরকার। এর ১৪ মাস পর সেটা কার্যকর করা হলো।

নতুন সড়ক আইনটি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিতর্ক থাকলেও এ রকম একটি কঠোর আইনের দরকার ছিল। তবে আইনটি সম্পর্কে দেশবাসীকে ভালোভাবে না জানানোয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে আইনজ্ঞ, পথচারী, চালক ও যাত্রীসেবা নিয়ে কাজ করা সংগঠনের নেতাদের মধ্যে। আর আইনে সড়ক মনিটরিং সেলে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের লোকদের রাখা নিয়েও আছে আপত্তি।

দুর্ঘটনা রোধে নতুন আইন শক্তভাবে প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিষদের সভাপতি ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসতে পারে। সড়ক মনিটরিং সেলে যারা কাজ করছেন সেখানে শ্রমিকপক্ষের লোকদের রাখা উচিত হয়নি।’

সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ও সাবেক এলজিইডি প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গাকে সড়ক মনিটরিং সেলে রেখে সড়কে পথচারীদের পক্ষে আইনের প্রয়োগ হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ব্যারিস্টার হুমায়ুন। তিনি বলেন, ‘তারা পরিবহন শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের প্রধান নেতা। তাদের কাছে বিচার দিলে শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ পথচারী ও যাত্রীর বিপক্ষে যাবে।’ এটা এই আইনের একটি বড় গলদ বলে মনে করেন তিনি।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে শক্তভাবে আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই। আর সিস্টেম উন্নত করতে হবে। সড়কে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ টিম থাকতে হবে।’

শিক্ষার্থীদের জন্য ভাড়ায় ছাড়ের মত দিয়ে ব্যারিস্টার আশরাফুল বলেন, ‘এটি নিয়ন্ত্রণ করবে বিআরটিএ। এ বিষয়ে বিআরটিএ আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে যৌথ যোগাযোগ থাকতে হবে। যাতে করে কেউ এই ভাড়া নিয়ে ঝামেলা না করতে পারে।’

সড়কে যাত্রী ও পথচারীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিশচা)-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন মনে করেন, নতুন আইনটি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে যাত্রী ও পথচারী উপকৃত হবে। তার দৃষ্টিতে আগের আইনের চেয়ে নতুন আইনটি ভালো হয়েছে।

নতুন আইনটি সড়কের জন্য কতটুকু কার্যকর হবেণ্ড এমন প্রশ্নের জবাবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘এক লাফে এত ওপরে ওঠা যায় না। তবে আইনটি ভালো হয়েছে। এখন এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে সেটিই দেখার বিষয়। যেকোনো আইন কার্যকর করার জন্য  ধীরে ধীরে পরীক্ষা করে আগাতে হয়। এক লাফে এত দূরে আগানো যায় না।’

আইন প্রয়োগে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে কি না সেটি সময়ই বলে দেবেণ্ড এমন মন্তব্য করে যাত্রীকল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘তবে এ রকম একটি আইনের প্রয়োজন ছিল। ঘাটতি পূরণ হয়েছে, এটা ইতিবাচক দিক।’ চালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিষয়টি ইতিবাচক বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তবে যারা অশিক্ষিত পুরোনো ড্রাইভার তাদের কর্মের কী হবে, সেটাও ভাবতে হবে।

মোজাম্মেল আরও বলেন, ‘বিআরটিএ ২০ থেকে ২১ হাজার চালকের লাইসেন্স দিয়েছে। আরও ৫০ হাজার চালক আছে যাদের লাইসেন্স নেই। তারা কী করবে? তারা তো প্রশিক্ষণ নেওয়া ও অভিজ্ঞ। তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে পারছে না বিআরটিএ। বিআরটিএর সিস্টেমে আরও আগানোর পরামর্শ দেন তিনি।

আইনটি সম্পর্কে সব মহলে প্রচারণা না হওয়া একটা বড় দুর্বলতা বলে মন্তব্য করেন মোজাম্মেল হোসেন। ‘না জানিয়েই আইনটি কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়াটা ঠিক হয়নি। অনেক ট্রাফিক পুলিশ, সাধারণ মানুষ, চালক পথচারী আছেন যারা এ আইন সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এ জন্য আইনটি প্রয়োগ নিয়ে শঙ্কায় আছি।’

নতুন আইন নিয়ে প্রচারণা না হওয়ার বিষয়টি সরকারি কর্তৃপক্ষও বুঝতে পারছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, নতুন আইনে প্রথম সাত দিন কোনো মামলা না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখন সারা দেশ সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

এদিকে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শাস্তি বাড়ানোর বিরোধিতা করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান নতুন এই আইন নমনীয় করার দাবি জানান।

তিনি বলেন, ‘যদি সব মামলায় ৩০২ ধারা (মৃত্যুদণ্ড) রাখা হয়, ড্রাইভারকে যদি যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়, ওই চালকের গরিব পরিবারের কী হবে? তাছাড়া আমাদের দেশে এমনিতেই লাখ লাখ ড্রাইভার কম আছে। জামিনযোগ্য না হলে ড্রাইভারের সংকট আরও বাড়বে। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা দরকার।’

চালকদের মধ্যেও আপত্তি আছে আইনে কঠোর শাস্তির বিধান থাকায়। ট্রাস্ট পরিবহনের একজন চালক রশিদ বলেন, ‘এত কঠিন শাস্তির মধ্যে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। আর বেশি দিন মনে হয় গাড়ি চালাইতে পারব না।’

নতুন আইনের উল্লেখযোগ্য ১৪টি বিধান

সড়কে গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হত্যা করলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

সড়কে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালালে বা প্রতিযোগিতা করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

মোটরযান দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত বা প্রাণহানি হলে চালকের শাস্তি   সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল ও সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা।

ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান বা গণপরিবহন চালানোর দায়ে ছয় মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।

নিবন্ধন ছাড়া মোটরযান চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা।

ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার এবং প্রদর্শন করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড।

ফিটনেসবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ মোটরযান চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।

ট্রাফিক সংকেত অমান্য করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।

সঠিক স্থানে মোটরযান পার্কিং না করলে বা নির্ধারিত স্থানে যাত্রী বা পণ্য ওঠানামা না করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা।

গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানা।

একজন চালক প্রতিবার আইন অমান্য করলে তার পয়েন্ট বিয়োগ হবে এবং এক পর্যায়ে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে।

গণপরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।

আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে চালককে অষ্টম শ্রেণি পাস এবং চালকের সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পাস হতে হবে (আগে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো প্রয়োজন ছিল না)।

গাড়ি চালানোর জন্য বয়স অন্তত ১৮ বছর হতে হবে। (এই বিধান আগেও ছিল।)

এ ছাড়া সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনো যাত্রী বসলে এক মাসের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে।

প্রকাশ :নভেম্বর ৩, ২০১৯ ১২:৩৭ অপরাহ্ণ