শাহ আলম,রাঙামাটি
দুর্যোগ অনেকটা মোকাবেলার সম্ভব হলেও ভয়াল পাহাড় ধসের ঘটনার পর গত এক মাসেও রাঙামাটিতে স্বাভাবিক গতি ফেরেনি। করুণ আর্তিতে এখনও আশ্রয় কেন্দ্রে মানবেতর পরিস্থিতির মধ্যে দিনযাপন করছেন স্বজন ও বাড়িঘরহারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। অনেকে রয়েছেন আত্মীয় বাড়ি। কেউ ফিরতে পারেননি নিজের ঘরে। তারা দিন গুনছেন সরকারের পুনর্বাসনের অপেক্ষায়। যান চলাচলে সচল হয়ে ওঠেনি রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কসহ অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় গতি ফেরেনি ব্যবসা বাণিজ্যে। স্বাভাবিক হতে পারেনি জনজীবন।
প্রসঙ্গত ১৩ জুন রাঙ্গামাটিতে স্মরণকালের রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতে প্রবল বর্ষণ হয়। ১০ জুন হতে অবিরাম ভারি বর্ষণ শুরু হয়। ১২ জুন রাত থেকে ১৩ জুন সকাল পর্যন্ত সদরসহ জেলাব্যাপী ভয়াল পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। পাহাড় ধসে ৫ সেনা সদস্যসহ ১২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে পুরষ ৪৭, নারী ৩৫ ও শিশু ৩৮ জন। এদের মধ্যে নিখোঁজ ৫ জনকে প্রশাসন মৃত ঘোষণা করলেও তাদের মরদেহ আজও উদ্ধার করা যায়নি। তারা হলেন- শহরের ভেদভেদী মুসলিমপাড়ার মো. শাহজাহান (৯), রুবি আক্তার (৩৬) এবং রপনগরের সালাউদ্দিন (৩২), রহিমা বেগম (২৫) ও দরবেশ আলী (৩৫)। সম্পূর্ণ বিধ্বস্তসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২ হাজার বাড়িঘর। সরকারি স্থাপনাসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ১২শ’ কোটি টাকার সম্পদ। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কসহ জেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সড়ক যোগাযোগ। ভারি যান চলাচল বন্ধ থাকায় এখনও পুরোপুরি সচল হতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই ঘটনায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাড়িঘরের পরিবারসহ ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন আশ্রয় নেন সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে। এরই মধ্যে তাদের কেউ কেউ নিজেদের বাড়িঘর মেরামত করে এবং আত্মীয় বাড়ি গিয়ে ফিরলেও এখনও শহরের ১৫ আশ্রয় কেন্দ্রে দুই হাজারের অধিক লোকজন মানবেতর পরিস্থিতিতে দিনযাপন করছেন।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খোন্দকার মো. ইখতিয়ার উদ্দিন আরাফাত জানান, ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয়ে শহরে ১৯ আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৩ হাজারের অধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে অনেকে কেন্দ্র ছেড়ে চলে যাওয়ায় চারটি বন্ধ করা হয়। বর্তমানে ১৫ কেন্দ্রে প্রায় দুই হাজারের অধিক দুর্গত মানুষ অবস্থান করছেন। তাদেরকে সরকারের তরফ থেকে নিয়মিত খাবার, পানি, কাপড়সহ ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। পুনর্বাসন না করা পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্র খোলা থাকবে। তবে কমিয়ে কেবল চারটি কেন্দ্রে আশ্রিতদের স্থানান্তরিত করা হবে। এ চার কেন্দ্র স্থাপন করা হবে রাঙামাটি স্টেডিয়ামের হল রুম, জিমনেসিয়াম হল, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজেল ছাত্রাবাস এবং রাঙামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ডরমেটরি ভববন।
এদিকে পাহাড় ধসের ঘটনায় রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলোর মেরামত করে হালকা যান চলাচল উপযোগী করা হলেও ভারি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। রাঙামাটি-মানিকছড়ি-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কে এখনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এছাড়া জেলার রাঙামাটি-কাপ্তাই, ঘাগড়া-চন্দ্রঘোনা-বাঙালহালিয়া-বান্দরবান, রাণীরহাট-কাউখালী, বগাছড়ি-নানিয়ারচর-লংগদু এবং বাঙালহালিয়া-রাজস্থলী সড়কে হালকা যান চলাচল করলেও এখনও ভারি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ ৫টি সড়কই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকেশৗলী এমদাদ হোসেন বলেন, রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কসহ জেলার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর যে হারে ক্ষতি হয়েছে সেগুলো স্বাভাবিক করতে কিছুটা সময় লাগবে। মেরামত কাজে তোড়জোর চলছে। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের সদরের সাপছড়ির শালবনে বিধ্বস্ত স্থানে ভরাট করে হালকা যান চালু করা হয়েছে। ভারি যান চলাচল উপযোগী করতে শালবনের বিধ্বস্ত স্থানের উত্তর পাশে একটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। ব্রিজটির নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে সরাসরি ভারি যান চলাচল খুলে দেয়ার চেষ্টা চলছে। রাঙামাটি-মানিকছড়ি-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কে মেরামত কাজ চলছে। কিছু দিনের মধ্যে ওই সড়কে যান চলাচল করতে পারবে। রাঙামাটি-কাপ্তাই, ঘাগড়া-চন্দ্রঘোনা-বাঙালহালিয়া-বান্দরবান, রাণীরহাট-কাউখালী, বগাছড়ি-নানিয়ারচর-লংগদু এবং বাঙালহালিয়া-রাজস্থলী সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলোতে মেরামত কাজ চলছে।
এদিকে পাহাড় ধসের ঘটনার পর রাঙামাটির সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, খাদ্য, জ্বালানিসহ নানা সংকট দেখা দেয়। সড়ক যোগাযোগ পুরোপুরি সচল না হওয়ায় এসব ক্ষেত্রে এখনও স্বাভাবিক গতি ফেরেনি। স্বাভাবিক হতে পারেনি জনজীবন। একমাস পরও পুনর্বাসন নেই ক্ষতিগ্রস্তদের। অনেকের সঙ্গে কথা হলে সরকারিভাবে পুনর্বাসনের দাবি করেছেন তারা। আতঙ্কে বিধ্বস্ত এবং ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় ফিরতে চান না ক্ষতিগ্রস্তরা। পুনর্বাসন চান অন্য নিরাপদ স্থানে। অপেক্ষা করছেন সরকারের সহায়তায় পুনর্বাসন নিয়ে। প্রশাসনও চায় না বিধ্বস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় কাউকে ফেরাতে। ক্ষতিগ্রস্তদের স্থায়ী পুনর্বাসনে প্রশাসন খুঁজছে উপযুক্ত জায়গা।
জেলা প্রশাসক মো. মানজারুল মান্নান বলেন, পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছে। তবে যেখানে সেখানে নয়, নিরাপদ ও উপযুক্ত জায়গায় পুনর্বাসন করা হবে। এজন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে।
তিনি বলেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় যা যা করণীয় সরকারের পক্ষে সব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় নগদ ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, ৬০০ টন চাল ও ২ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়মিত খাবারসহ ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের গৃহনির্মাণ মঞ্জুরি নগদ ১৫ লাখ টাকা এবং ৫০০ বান্ডেল ঢেউটিন সরকারি বরাদ্দ পাওয়া গেছে। পুনর্বাসন না করা পর্যন্ত দুর্গত মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হবে। এজন্য ত্রাণ সহায়তা এখনও পর্যাপ্ত রয়েছে।
দৈনিক দেশজনতা/এন আর