২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৭:৪৪

সীমান্তে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার টহল, সংঘাত বাড়ার শঙ্কা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সীমান্তের সরু খাল বেয়ে বা কাঁটাতারের বেড়া গলিয়ে আসছে আক্রান্ত শত শত রোহিঙ্গা নারী ও শিশু। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরুর পর তারা দলে দলে ঘর ছাড়ছেন। রোববারও সীমান্ত এলাকা বেশ থমথমে ছিল। স্থানীয়রা ধারণা করছেন, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ফলে এবারের সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে কী ঘটবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকতে পারছে না। তারা সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অত্যন্ত মানবেতন অবস্থায় আছেন। ফলে বড় ধরনের মানবিক বির্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে, রোববার দুপুর ও বিকালে ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার টহল দিতে দেখা গেছে। তবে রোববার ওপার থেকে গুলির শব্দ আর তেমন শোনা যায়নি। অন্যদিকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে রাত-দিন অতন্ত্র প্রহরীর মতো সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি। বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল আবুল হোসেন জানান সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আরও ১৫ হাজার সদস্য বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা। তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের বাহিনী বা কোনো সন্ত্রাসী দলের অনুপ্রবেশ শক্ত হাতে মোকাবেলার ঘোষণা দিয়েছেন। বিজিবি ডিজি হুঁশিয়ারি দিয়ে সীমান্তের জিরো লাইন ক্রস করলে সমুচিত জবাব দেয়া হবে এবং তিনি আরও বলেন, ‘আপনার নিশ্চিত হতে পারেন আমাদের এখানে গোলাগুলি তথা আমাদের জিরো লাইন ক্রস করবে না। যদি করে থাকে আমরা সমুচিত জবাব দেব।’ এর আগে বিজিবির মহাপরিচালক ঘুমধুম সীমান্তের জিরো লাইন পরিদর্শন করেন। মিয়ানমারের রাখাইনের সংঘাত থেকে বাঁচতে সেখানে বেশ কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। পলিথিনের ছাউনি দিয়ে সেখানে গাদাগাদি করে অসহায় এসব রোহিঙ্গারা শুক্রবার থেকে কখনও রোদে পুড়ছেন, কখনও বৃষ্টিতে ভিজছেন। শতবর্ষী বৃদ্ধ বদিউর রহমান ও তার স্ত্রী মোস্তফা খাতুন যেন ভয়ে আরও বেশি কুঁকড়ে ছিলেন। সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলা করতে পারেন না তারা। কোলে করে রাখাইনের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে উদ্ধার করে এপারের এনেছেন অন্যরা। ‘ওরা গুলি করতে করতে আমাদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। আমাদের জোয়ান ছেলেদের গুলি করে হত্যা করে’ নিচু স্বরে কথাগুলো বললেন বদিউর রহমান, যিনি নিজের বয়স ১০০। জীবন সায়াহ্নে উপস্থিত বদিউর রহমান ভয়ে অনেকটাই চুপসে গেছেন। তিনি ও তার স্ত্রী প্রাণে বেঁচে এপারে আসতে পারলেও, তারা পরিবারের অন্যদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানেন না। বদিউর রহমানের মতো অনেক বৃদ্ধকে নিষ্পলক, অসহায় বসে থাকতে দেখা যায় অস্থায়ী ছাউনিতে। কাদামাখা হাত-পা। দেখে বুঝাই যায়, তাদের কতটা কষ্ট হয়েছে ভয়াল সেই রাত্রিতে এপারে আসতে।

শিশুরা প্রচণ্ড রোদের সঙ্গে ক্ষুধায় কাঁদছে। আশপাশের মানুষ মুড়ি, বিস্কুটসহ শুকনো খাবার দিয়ে গেলেও তা একদমই কম। ফলে খাবার আনার সঙ্গে সঙ্গেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর কাজী মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘যারা বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশ করছেন, তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে না। স্থানীয়রা তাদেরকে খাবার-দাবার দিচ্ছে।’ রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমঘুমের জলপাইতলি জিরোপয়েন্ট, তমব্রু, কলাতলী পয়েন্ট, পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমান পাড়ার রহমতের বিল, উলুবুনিয়ার সীমান্ত, হোয়াইকংয়ের সীমান্ত পয়েন্টে থেমে থেমে এপারে ঢুকেছেন আরও অনেক রোহিঙ্গা নারী ও শিশু। বিগত কয়েক দশক ধরেই রক্তাক্ত মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন। রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিমদের দেশটির নাগরিক হিসেবে স্বীকার করেনি জান্তা সরকার। মাঝে মাঝেই তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের নির্মমতা। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে উগ্রপন্থী বৌদ্ধারাও চালায় হত্যাযজ্ঞ। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া আর রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ যেন নিত্য ব্যাপার। মিয়ানমার সরকার চলতি মাসের শুরুতে রাখাইনে সেনা মোতায়েন করে অভিযানের ঘোষণা দেয়। এরই মধ্যে গ্রামের পর গ্রাম রোহিঙ্গাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর বদলা নিতেই রোহিঙ্গা যোদ্ধারা অন্তত ২৫টি পুলিশ পোস্টে হামলা ও একটি সেনাঘাঁটিতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ শুরু হয়।

গত বছরের অক্টোবরে এমনই এক হামলার ঘটনায় জাতিসংঘের সাবেক প্রধান কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন তাদের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার এবং তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের আহ্বান জানায়। এরপর কয়েক ঘণ্টা পরই বৃহস্পতিবার এ ঘটনা ঘটে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম খবর দিয়েছে এই সংঘর্ষে রোববার সকাল পর্যন্ত ৯৬ জন নিহতের এর মধ্যে ৮৪ রোহিঙ্গা মুসলিম আর ১২ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন।

আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি (এআরএসএ) এক টুইট বার্তায় এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগ এনে তারা জানায়, তারা ২৫টির বেশি এলাকায় আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সংগঠনটি দাবি করে, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলীয় রাথেতুয়াং শহর এলাকা গত দুই সপ্তাহ ধরে অবরুদ্ধ। সেখানে রোহিঙ্গারা না খেয়ে মারা যাচ্ছেন। মাউংদোতেও তারা যখন একই কাজ করতে যাচ্ছিল, তখন বার্মিজ উপনিবেশিক বাহিনীকে হটাতে চূড়ান্ত পর্যায়ে এই পদক্ষেপ নিয়েছি। বরাবরের মতো গত বছরের অক্টোবরে এ ধরনের সংঘর্ষের পর প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। পরে তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষের পরও নির্যাতিত রোহিঙ্গারা একইভাবে স্রোতের বেগে সীমান্তে আসছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ২৭০ কিলোমিটার সীমান্ত। এসব এলাকায় বাংলাদেশ সীমান্ত বাহিনী বিজিবির কড়া নজরদারি থাকা সত্ত্বেও তারা রাতে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে আসা দুই রোহিঙ্গা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। স্থানীয়দের ধারণা, অন্তত ৩ থেকে ৫ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে অনুপ্রবেশ করেছে।

দৈনিকদেশজনতা/ আই সি

 

প্রকাশ :আগস্ট ২৮, ২০১৭ ১০:১০ পূর্বাহ্ণ