নিজস্ব প্রতিবেদক:
ভিসা জালিয়াতি ও গৃহকর্মীকে মজুরি না দেয়ার অভিযোগে জাতিসংঘে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মকর্তা ড. হামিদুর রশিদ গ্রেপ্তার হয়েছেন। হামিদুর রশিদ ঢাকায় পররাষ্ট্র দফতরের মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি লিয়েনে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে প্রোগ্রাম ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত।
রয়টার্স প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশি কর্মকর্তা ড. হামিদুর রশিদ প্রথমত ভিসা জালিয়াতি করেই বাংলাদেশ থেকে কাজের লোক নিয়ে এসেছিলেন। এর বাইরে, তিনি ওই কাজের লোককে যৌক্তিক পারিশ্রমিক প্রদান করেননি।
এই প্রতিবেদকের তরফে এ ব্যাপারে নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনে ফোন করে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কেউ ফোন ধরেননি। তবে অন্য একটি সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানানো হয়েছে যে, মিশনের বর্তমান প্রধান তাকে জানিয়েছেন, যেই ভদ্রমহিলা ন্যায্য পারশ্রমিক না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন, সেই মহিলা যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর গত চার বছর ধরেই নিখোঁজ ছিলেন। কূটনীতিক হামিদুর রশিদ এই নিয়ে প্রাথমকি খোঁজ-খবর করে আর বেশি দূর এটি নিয়ে আগাননি।
এক মাসের ব্যবধানে দু’জন বাংলাদেশি কূটনীতিকের গ্রেপ্তারের খবরে বেশ বিব্রত নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটি। এসব ঘটনায় মানবাধিকার আর শ্রমিকের প্রতি ন্যায় বিচারে বাংলাদেশের মানুষের অবস্থান নিয়ে ইমেজ সংকট তৈরি হতে পারে বলে ধারণা তাদের।
হামিদুর রশিদকে একজন ভাল মানের কূটনীতিক হিসেবে মানেন তার সঙ্গে কাজ করা অনেক সাংবাদিক। অবশ্য স্থানীয়রা বলছেন, এই হামিদুর রাশিদ এর আগে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তার সাবেক স্ত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগে।
মঙ্গলবার ম্যানহাটন ফেডারেল আদালতে কূটনীতিক হামিদুর রশিদের বিরুদ্ধে ভিসা জালিয়াতি, বৈদেশিক শ্রমিক নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালার লঙ্ঘন আর পরিচয় গোপন রেখে শ্রমিক আমদানির অভিযোগ আনা হয়। হামিদুর রশিদ বা তার পক্ষে কোনো আইনজীবী মামলা পরিচালনা করছেন সেটা এখনো জানা যায়নি।
এর আগে শ্রমিক পাচার, গৃহপরিচারককে নির্যাতন, বেতন না দেওয়ার অভিযোগে গত ১২ জুন নিউইয়র্কের ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুল ইসলাম গ্রেপ্তার হন। পর দিন ৫০ হাজার ডলার বন্ড দিয়ে ছাড়া পান তিনি। আর ২০১৪ সালে নিউইয়র্কের তৎকালীন কনসাল জেনারেল মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায় একই ধরনের অভিযোগ আনেন তার গৃহকর্মী। অভিযোগ দাখিলের দিনই খবর পেয়ে সপরিবারে নিউইয়র্ক ত্যাগ করেন মনিরুল ইসলাম। ওই গৃহকর্মী পরবর্তীতে আমেরিকায় স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
যার যার কাজ তার তার করার রীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশ থেকে যেসব কূটনীতিকরা আসেন সপরিবারে, তারা তাদের নিত্য কাজের জন্য কাজের লোক নিয়ে আসেন স্বীকৃত আইনি পন্থায়। দেশে কাজের লোককে যে পারিশ্রমিক দিতে হয়, এখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মের মধ্যে সেই পারিশ্রমিক বেড়ে দাঁড়ায় কয়েক গুণ বেশি। তাই, কাজের লোককে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনে পারিশ্রমিক না দিয়ে বাংলাদেশের নিয়মে চালানোর চেষ্টা করেন অনেক কূটনীতিক। সেই কারণে কূটনীতিক গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়টি এর আগেও হয়েছে।
ভারতের এক নারী কূটনীতিককে আটক করার পর, দুই দেশের সম্পর্ক বেশ নাজুক অবস্থায় চলে গিয়েছিলে। সাহেদুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই কাজের মানুষেক নিয়মানুযায়ী পরিশোধ না করার বিষয়টি সত্য। তবে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দু’জন কূটনীতিকের বিরুদ্ধে এমন মামলা আর গ্রেপ্তারের পেছনে অন্য কোন কিছু আছে বলে মনে করছেন, নিউইয়র্কের মানবাধিকার কর্মীসহ অনেকেই।
মানবাধিকার, অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংগঠন ড্রাম এর বাংলাদেশি সংগঠন কাজী ফৌজিয়া এই প্রতিবেদেকর সঙ্গে আলাপকালে জানান, মনে হচ্ছে একটি ঘটনা দেখে অন্যজন প্রভাবিত হয়েছেন। ওই নারী শ্রমিক দীর্ঘ চার বছর নিজের মত সময় কাটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এখন, গত সপ্তাহে একজন শ্রমিকের আদালতে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তার স্থায়ী বসবাসের সুযোগ বা গ্রিন কার্ড পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তাতেই হয়তো অন্যজন অনুপ্রাণিত হয়ে থাকতে পারেন, বলছিলেন কাজী ফৌজিয়া।
কূটনীতিকদের বাসায় কাজ করে এমন শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য একটি বেসরকারি সংস্থা আছে নিউইয়র্কে। ন্যাশনাল ডমেস্টিক ওয়ার্কার অ্যালায়েন্স নামক এই সংস্থাতে শ্রমিকদের যোগদান বাধ্যতামূলক নয়। তবে প্রবাসে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্যে অনেকেই এর সদস্য পদ নেন। এই এনজিও, সময়ে সময়ে নানা রকম সেমিনার আর প্রচারণার মাধ্যমে শ্রমিকদেরকে তাদের ন্যায্য পাওনা সম্পর্কে সচেতন করে।
কাজী ফৌজিয়া জানান, এই ধরনের ক্ষেত্রে আদালতে অভিযোগ করার পর, যদি ট্রাফিকিং ভিসা অর্জন করতে পারেন কোনো নাগরিক, তবে তার ২ বছরের মধ্যেই গ্রিনকার্ড হয়ে যায়। আবার, ইউ ভিসা নামক একটি স্থায়ী বসবাসের সুযোগ তৈরি হয় ওইসব নাগরিকের ক্ষেত্রে যদি তারা প্রমাণ করতে পারেন কোনো নাগরিক দ্বারা তার ন্যায্য পাওনা বঞ্চিত করা হয়েছে।
হামিদুর রশিদের গ্রেপ্তারে ওই শ্রমিক বা কাজের লোকের উপর আসলেই কোনো নির্যাতন হয়েছিল কিনা এখনি তা পরিষ্কার নয়, তবে একের পর কূটনীতিকের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের মামলা করার ঘটনার পেছনে নির্যাতনের বাইরেও, গ্রিন কার্ড পাওয়া সংক্রান্ত বিষয়গুলো জড়িত থাকতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।
দৈনিক দেশজনতা/ এন আর