২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৬:২৩

আশ্রয় কেন্দ্রেও শঙ্কা, ঝুঁকিতে সরকারি ভবনসহ অনেকগুলো স্থাপনা

রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি:
১৩ জুন পাহাড় ধসের পর রাঙ্গামাটি শহরের বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নেন বহু মানুষ। তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত এবং ঝুঁকিতে বসবাসকারী। কিন্তু ভবন ঝুঁকিতে পড়ায় আশ্রয় কেন্দ্রেও বিরাজ করছে শঙ্কা। এছাড়া দুর্যোগের পর নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখলেও বিধ্বস্ত ভিটায় গিয়ে আবার বাড়িঘর করার সাহস করছে না ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। অনেকে আছেন ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ভাবছেন কিন্তু ভয় পিছু ছাড়ছে না।
পাহাড় ধসের দিন বিকালে শহরের শিমুলতলী সংলগ্ন রাঙ্গামাটি টেলিভিশন সম্প্রসারণ উপকেন্দ্র ভবনে খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র। সোমবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, আশ্রিতরা শঙ্কার মধ্যে। শঙ্কিত কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ। রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক ঘেঁষে পাহাড়চূড়ায় নির্মিত ভবনের তিন দিকেই পাহাড় ধস হয়েছে। ধসের ফলে পানি সরবরাহ সিস্টেমটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে বলে জানান, উপকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা টেলিভিশন প্রকৌশলী নাসিমুল হক। ওই সময় ভবনের চারপাশে পাহাড় ধসের স্থানগুলো ঘুরে দেখান। আবার ভারী বৃষ্টি হলে ভবনটির অবস্থা আরও মারাত্মক হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
এই টিভি প্রকৌশলী জানান, বিষয়টি গণপূর্ত বিভাগসহ উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। ভবনের পূর্ব-উত্তর কোণসহ তিন দিকে পাহাড় ধস হয়েছে। ফলে ভবনটি এখন ঝুঁকিতে। পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট হওয়ায় এখানে পানির সংকট হচ্ছে। আশ্রিতদের মাঝে বাইরে থেকে নিয়ে এসে পানি সরবরাহ দেয়া হলেও এত লোকজনের জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে শৌচাগারসহ সার্বিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নোংরা হয়ে পড়ছে।
এ অবস্থায় সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন আশেপাশের প্রায় তিন শতাধিক মানুষ। তাদের অনেকে বাড়িঘর ও স্বজন হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। অনেকে ঝুঁকিতে বসবাসকারী। আবদুল মজিদসহ (৫০) আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানকারীরা বলেন, বাড়িঘরসহ সব হারিয়ে এবং ঝুঁকি এড়াতে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। কিন্তু ভবনটির আশেপাশে ব্যাপক পাহাড় ধস হওয়ায় সেখানেও তারা শঙ্কিত।
তারা বলেন, ওই আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার, পানির তেমন কোনো সমস্যা নেই। ত্রাণও পাচ্ছেন যথেষ্ট পরিমাণে। কিন্তু বাড়িঘর হারিয়ে বা বাড়িঘর ছেড়ে একস্থানে এত মানুষের গাদাগাদিতে নানান সংকটে পড়তে হচ্ছে। ওই কেন্দ্রে প্রায় ৭০ পরিবারের তিন শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান তারা।
পাহাড় ধসে সরকারি স্থাপনার মধ্যে অধিক ঝুঁকির তালিকায় আঞ্চলিক পাসপোর্ট ভবন, বেতার ভবন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট ভবন, সার্কিট হাউস, পুলিশ সুপারের বাংলো, জেলা প্রশাসকের বাংলো, মৎস্য ভবনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
টিভি উপকেন্দ্রের সামনে আঞ্চলিক পাসপোর্ট ভবন। দুর্ঘটনার দিন বিকালে সেখানেও আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। কিন্তু ভবনটি পাহাড় ধসের ফলে ঝুঁকিতে পড়ায় কিছু দূরের বেতার ভবনে সরিয়ে নেয়া হয় আশ্রিতদের। তা ছড়া ভবনটি করা হয়েছে পাহাড়ের ওপর ফেলা ময়লা-আবর্জনা স্তুপে। তার ওপর আশেপাশে ব্যাপকহারে পাহাড় ধস হয়েছে। ফলে ফের ভারী বৃষ্টিতে অবস্থা আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহাকারী উপ-পরিচালক বলেন, ভবনের উত্তর পাশে ব্যাপক হারে পাহাড় ধস হয়েছে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে ভবনটি। রক্ষার জন্য গাইড ওয়াল দিতে গণপূর্তকে জানিয়েছি।
আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ভবনের পর বেতার কেন্দ্র ভবন। আশেপাশে ব্যাপক পাহাড় ধসে সেটিও ঝুঁকিতে। সেখানে প্রায় কয়েকশ’ মানুষ আশ্রিত। ফের ধসের আশঙ্কায় শঙ্কিত তারা।
শহরের ভেদভেদীতে স্থাপিত উপজাতীয় যাদুঘরসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভবনের আশেপাশে ব্যাপক পাহাড় ধস হওয়ায় সেটিও মারাত্মক ঝুঁকিতে। ঝুঁকিতে সার্কিট হাউস। সার্কিট হাউসটির ধস রোধে কাজ করা হচ্ছে।
শহরের রিজার্ভবাজার চেঙ্গিমুখে অবস্থিত পুলিশ সুপারের বাংলোর সীমানাপ্রাচিরসহ পাহাড়ের একাংশ ধসে কাপ্তাই হ্রদে মিলিয়ে গেছে। ধসের কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে মৎস্য ভবনটি। সরকারি স্থাপনার মতো সড়ক, বসতবাড়ি, ভবন ও দোকানপাটসহ ঝুঁকিতে অসংখ্য স্থাপনা। অভ্যন্তরীণসহ বিভিন্ন সড়কে লাল পতাকা ও বালুর বস্তা দিয়ে বিভাজক তৈরি করে ঝুঁকির চিহ্ন দেয়া হয়েছে।
রাঙ্গামাটি গণপূর্ত বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী জহির রায়হান বলেন, শহরে ভবনগুলোর ক্ষতির নির্ধারণসহ তালিকা নিরূপণের কাজ চলছে।
এদিকে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কসহ অভ্যন্তরীণ সড়কের বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় ধস হয়েছে। সড়কের বিভিন্ন অংশে দেখা যায় ফাটলের চিত্র। এক সপ্তাহেও সচল হয়নি রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে যান চলাচল। তবে শিগগির হালকা যান চলাচল উপযোগী করা যাবে বলে জানান, জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান ও সামরিক কর্মকর্তারা।
জেলা প্রশাসক বলেন, পরিস্থিতি ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। বৈরি আবহাওয়া ছাড়া অন্য কোনো সংকট আর নেই। পাহাড় ধসের ঘটনায় উ™ভূত সংকটগুলো মেকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে।
এদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অনেকের বাড়িঘর পাহাড় ধসে বিধ্বস্ত। অনেকে হারিয়েছেন স্বজনসহ সব। আবার অনেকের বাড়িঘর আংশিক বা প্রায় অংশের ক্ষতিতে চরম ঝুঁকিতে। আর কারও কারও বাড়িঘর অক্ষত থাকলেও আশেপাশে ব্যাপক পাহাড় ধস হওয়ায় এখন রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। যা ফের বর্ষণে যে কোনো মুহূর্তে ধসে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়।
সরেজমিন দেখা যায়, পাহাড় ধসের পর শহরসহ জেলায় ঝুঁকিতে অহরহ স্থাপনা। ভেঙে চুড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে অনেক স্থান। যেগুলো পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে। দুর্যোগপূর্ণ এই পরিস্থিতির মুহূর্তে এখনও যার সঠিক তালিকা নিরূপণ করতে পারেনি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন। রাঙ্গামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, শহরসহ জেলায় ১৪৫ স্থানে ব্যাপক পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। রাঙ্গামাটি গণপূর্ত বিভাগ বলছে, ১৩ জুন পাহাড় ধসের ঘটনায় রাঙ্গামাটিতে সরকারি বেসরকারি অনেক ভবন ও স্থাপনার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। যে তালিকায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঝুঁকিতে পড়েছে।
অন্যদিকে রাঙ্গামাটিতে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। এতে ভয় পিছু ছাড়ছে না লোকজনকে। অনেকে ছুটছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখলেও বিধ্বস্ত ভিটায় ফিরে যেতে সাহস করছেন না ক্ষতিগ্রস্তরা। আশ্রয় কেন্দ্রে দুর্গতদের মাঝে খাবার ও ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। সরকারের পাশাপাশি ত্রাণ সহায়তায় এগিয়ে আসছে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, মহল ও ব্যক্তি। সোমবার নতুন করে কোনো মরদেহ উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়নি।

দৈনিক দেশজনতা/এন আর

প্রকাশ :জুন ২০, ২০১৭ ৯:৫৮ অপরাহ্ণ