নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর সড়কগুলোতে থৈ থৈ করছে পানি। সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু পানি জমে ঢাকার রাজপথ নদীতে পরিণত হয়। রাজপথের এ নদী দিয়ে কৃষকের ধানভর্তি পাল তোলা নৌকা পারাপারের দৃশ্য চোখে না পড়লেও পানির মধ্য দিয়ে গাড়ি চলাচলের মহা দুর্ভোগের দৃশ্য এখন নগরবাসীর কাছে অতি পরিচিত। একটু বৃষ্টি হলেই রাজপথ থেকে গলি পথ পানিতে একাকার হয়ে যায়। এতে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলি গলি পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। চরম ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। অফিস যাত্রী, স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীসহ অন্য সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে সকাল থেকেই নানা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে পড়তে হয়েছে দুর্ভোগে। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে অনেকেরই অফিসে যেতে হয়েছে। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় হাঁটুপানি জমে যাওয়ায় নগরীর সর্বত্র প্রচন্ড যানজটের সৃষ্টি হয়। ভয়াবহ এ যানজটের কারণে সময়ের অনেক আগে ঘর থেকে বের হয়েও কেওই সময় মতো অফিস, আদালত, স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পারেনি। যানবাহনের অপেক্ষায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আর কোন উপায় ছিল না।
দীর্ঘদিন ধরে ড্রেনেজ ব্যবস্থার কোন সংস্কার না করা এবং কোন কোন এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সর্বত্রই পানিতে ডুবে যায়। ডিএনডি বাঁধ এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই হাঁটু পানি জমে। এই এলাকায় নেই কোন ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ফলে বৃষ্টির পানি জমে থাকলেও সরে যাওয়ার কোন পথ থাকে না। তাই দিনের পর দিন হাটু পানিতেই চলাচল করতে হয় ওই এলাকার মানুষকে। পুরান ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা সবচেয়ে অপ্রতুল। হালকা বৃষ্টি হলেই ড্রেন ভরে রাস্তায় জমে যায় পানি। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত ও পচা পানিতেই চলতে হয়ে পুরান ঢাকাবাসীকে। একই অবস্থা রাজধানীর অন্যান্য এলাকারও। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে নগরীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তা খোঁড়াখুড়ির জন্যও খানা খন্দকের সৃষ্টি হয়ে পানি জমে। রাস্তার এসব গর্তে যানবাহন পড়ে অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে।
রাজধানীর পুরান ঢাকায় নানা মৌসুমী ফল ব্যবসা করেন আলি কদম। তিনি বলেন, সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাতে হাঁটু পানি কোমড় পানি জমে যায়। এতে করে আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষদের পড়তে হয় চরম বিপাকে। পানি জমে রাস্তা ঘাট থৈ থৈ করে। দোকান পাট খুলতে পারি না। আমাদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে দ্রুত পানি নামতে পারেনা বলে ভোক্তভোগীরা ঢাকা ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বিশেষ করে গত মঙ্গলবার রাতের টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গেছে। গতকাল বুধবার সকাল থেকে কর্মমুখী মানুষকে পড়তে হয়েছে চরম ভোগান্তিতে। বিভিন্ন সড়কে পানিবদ্ধতার কারণে নগরজুড়ে তীব্র যানজটের পাশাপাশি পরিবহন সঙ্কটও দেখা গেছে।
সকালে রাজধানীর মতিঝিল, বঙ্গবাজার, পল্টন, নাজিমউদ্দিন রোড ও পুরনো ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এসব এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া মীরপুর, শ্যামলী, কালশী, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নতুন বাজার, খিলক্ষেত, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, বাড্ডা, খিলগাঁও, জুরাইন, পূর্বজুরাইনসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়িতে পানি উঠে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বৃষ্টির কারণে খানাখন্দে ভরা সড়কগুলোতে দুর্বিসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সকালে পরিবহন সঙ্কট দেখা দেওয়ায় অফিসগামী মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। রাজধানীর পানিবদ্ধতা বড় ধরনের সমস্যা হলেও তা নিরসনে এখনও পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদের কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা শান্তিনগরেরর পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে সফলতা পেয়েছি। নাজিমউদ্দিন রোডের পানিবদ্ধতা নিরসনে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আগস্টের মধ্যেই এ কাজ শুরু হবে। এরপর আর কোনও পানিবদ্ধতা থাকবে না। শান্তিনগরে এবছর ৮৫ ভাগ পানিবদ্ধতা কমে গেছে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্যান্য এলাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নগরীতে ভারী বর্ষণ হলে ডিএসসিসির মতিঝিল এলাকায় পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। এ বিষয়ে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, শান্তিনগরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মতিঝিলে আরও একটি প্রকল্প নেওয়া যায় কিনা তা চিন্তাভাবনা করছি।
ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন জানান, পানিবদ্ধতা নিরসনে তার সংস্থা থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩১০ কিলোমিটার নর্দমা পরিষ্কার এবং ২৩৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৪০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এ জন্য ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি অত্যাধুনিক জেট অ্যান্ড সাকার মেশিনও কেনা হয়েছে।
ডিএসসিসির পূর্ব জুরাইন ও ডিএনডি বাঁধ এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে পাম্পের মাধ্যমে পানি অপসারণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। তবে যেসব এলাকায় পাম্প ও ড্রেন বসবে বেদখল হওয়া সেসব এলাকায় প্রথমে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। এরপর পাম্পের মাধ্যমে পানি সেচ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হবে। ফলে এলাকার পানিবদ্ধতা কমবে বলে মনে করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। যদিও অন্যান্য বছরের মতো এবছরও এই এলাকাবাসীকে পানিবদ্ধতায় দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
স¤প্রতি ডিএনসিসির বাজেট বক্তৃতায় মেয়র আনিসুল হক বলেন, আমরা পানিবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধার অভিযানে নামছি। এরইমধ্যে ঢাকা ওয়াসা ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছি। কিছু কিছু খালের মধ্যে বহুতল ভবন পর্যন্ত উঠে গেছে। এ পর্যন্ত অন্তত চার শতাধিক ভবন ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে নগরভবনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উত্তর সিটি মেয়র আনিসুল হক বলেন, পানিবদ্ধতা নিরসনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৬৮ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন করা হয়েছে। গত অর্থবছরেও ৩০০ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন করা হয়েছে। পানিবদ্ধতা নিরসনে দুই সিট কর্পোরেশনে প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি অত্যাধুনিক জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন যুক্ত করা হয়েছে।
বলা হচ্ছে, এই যন্ত্রটি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা কাজ করতে পারবে। প্রতি ১০ মিনিটের মধ্যে ১২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা যাবে। কিন্তু, দুই মেয়র, সিটি কর্পোরেশন আর ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তাদের এত আশ্বাস ও কর্মসূচির পরেও পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নগরবাসী। এখনও সামান্য বৃষ্টি হলেই মিরপুর, কালশী, কারওয়ান বাজার, কুড়িল, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় জমে যাচ্ছে থৈ থৈ পানি।
মূলত পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ১৯৮৯ সালে সংস্থাটিকে পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি একাজে যুক্ত হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব পালন করলেও ঢাকা ওয়াসা তার মূল দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে এখন কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। ওয়াসার এই ব্যর্থতার দায় যাচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের ওপরে। এ জন্য দুই সিটি কর্পোরেশন ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থা তাদের অধীনে নিতে চায়।
এ বিষয়ে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা ড্রেনের দায়িত্ব নিতে চাই, তবে তা ঠিক করে দিতে হবে। জনবল দিতে হবে। আমরা এর রক্ষণাবেক্ষণ করবো। আর আনিসুল হক বলেন, আমরা ওয়াসার ড্রেন নেবো। এ নিয়ে শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হবে। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ওয়াসা থেকে জানানো হয়, শুধু ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণেই যে ঢাকায় পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তা কিন্তু নয়। এর পিছনে আরও অনেকগুলো কারণ রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার প্রায় ৬৭টি খালের মধ্যে আমরা ২৬ খালের দেখাশুনা করি। বাকি খালগুলোর অবস্থা ব্যহাল। যে ২৬টি খাল দেখাশুনা ওয়াসা করে সেগুলোও অর্থনৈতিক ও লোকবলের অভবে নিয়মিত খনন ও পরিস্কার করা যাচ্ছে না। এছাড়াও দখলদারদের উৎপাত তো রয়েছেই। শুধু মাত্র ওয়াসার একক চেষ্টায় ঢাকা শহরের এ সমস্যার দুর করা সম্ভব নয়। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য নরগবাসীকেও সহযোগীতা করতে হবে।
সরজমিন দেখা গেছে, দুপুর ১টার পর বৃষ্টির প্রকোপ কিছুটা কম আসে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে কাজীপাড়া থেকে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত শত শত মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু গণপরিবহনের দেখা নেই। সিএনজি অটোরিকশা সোনার হরিণ। রিকশা পাওয়া গেলেও ভাড়া আকাশচুম্বী। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে রাস্তার দুই ধারে আর গলিতে জমে থাকা পানি নগরবাসীর দুর্ভোগের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।
কেবল বেগম রোকেয়া সরণির কাজীপাড়া বা শেওড়াপাড়া নয়, সকাল থেকে টানা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে রাজধানীর অনেক এলাকার রাস্তাঘাট। বিভিন্ন গলিপথে জমে গেছে পানি। রাস্তায় পানির কারণে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ভীষণ ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী।
রাজধানীর দক্ষিণ দনিয়া এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই রস্তায় পানি জমে যায়। বিশেষ করে বর্ণমালা স্কুলের সামনে থেকে পশ্চিমে গোয়ালবাড়ী মোড় পর্যন্ত কোমর পানি জমে মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
তবে পানিবদ্ধতায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাচ্ছেন যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর থানার বাসিন্দারা। এ দুই থানার বেশিরভাগ এলাকা পানিবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সরজমিন দেখা গেছে, মাতুয়াইল, কোনাপাড়া, গোবিন্দপুর, শেখদী, দনিয়াসহ কয়েকটি এলাকার রাস্তা পানিতে তলিয়ে আছে।
মাতুয়াইল কবরস্থান রোড়ের বাসিন্দা এয়ার আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, আমার বাড়ির সামনে হাঁটুপানি জমে গেছে। চলাচলে খুবই অসুবিধা হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই খানবাড়ি মোড় থেকে কবরস্থান যাওয়ার রাস্তাটি পানিতে তলিয়ে যায়।
গতকাল ব্যাংক পাড়া মতিঝিলের বনশিল্প ভবন ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আশপাশে দেখা গেছে হাঁটু পানি। গতকাল ও এর আগের দিনের বৃষ্টিপাতে প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে রাজধানী। সময় মত পানি নেমে না যাওয়ায় প্রধান প্রধান সড়কে পানি জমে গেছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়গুলোতে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় গাড়ি চলাচলেও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও সড়কের ম্যানহোলের ঢাকনা না থাকায় অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। আবার পানিবদ্ধতার কারণে কোথাও কোথাও যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। শান্তিনগরে একটি জরুরি ওষধ সরবরাহকারী পিকআপ ভ্যান বিকল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। একটু বৃষ্টি হলেই রাজধানীতে পানি জমে যাওয়া নতুন কিছু নয়। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর রাস্তায় পানি জমে যায়। রাজধানীবাসী এ অভিযোগ বহুদিনের। এ যেন দেখার কেউ নেই অবস্থা।রাজধানীর সড়কগুলোতে থৈ থৈ করছে পানি। সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু পানি জমে ঢাকার রাজপথ নদীতে পরিণত হয়। রাজপথের এ নদী দিয়ে কৃষকের ধানভর্তি পাল তোলা নৌকা পারাপারের দৃশ্য চোখে না পড়লেও পানির মধ্য দিয়ে গাড়ি চলাচলের মহা দুর্ভোগের দৃশ্য এখন নগরবাসীর কাছে অতি পরিচিত। একটু বৃষ্টি হলেই রাজপথ থেকে গলি পথ পানিতে একাকার হয়ে যায়। এতে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলি গলি পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। চরম ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। অফিস যাত্রী, স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীসহ অন্য সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে সকাল থেকেই নানা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে পড়তে হয়েছে দুর্ভোগে। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে অনেকেরই অফিসে যেতে হয়েছে। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় হাঁটুপানি জমে যাওয়ায় নগরীর সর্বত্র প্রচন্ড যানজটের সৃষ্টি হয়। ভয়াবহ এ যানজটের কারণে সময়ের অনেক আগে ঘর থেকে বের হয়েও কেওই সময় মতো অফিস, আদালত, স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পারেনি। যানবাহনের অপেক্ষায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আর কোন উপায় ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেনেজ ব্যবস্থার কোন সংস্কার না করা এবং কোন কোন এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সর্বত্রই পানিতে ডুবে যায়। ডিএনডি বাঁধ এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই হাঁটু পানি জমে। এই এলাকায় নেই কোন ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ফলে বৃষ্টির পানি জমে থাকলেও সরে যাওয়ার কোন পথ থাকে না। তাই দিনের পর দিন হাটু পানিতেই চলাচল করতে হয় ওই এলাকার মানুষকে। পুরান ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা সবচেয়ে অপ্রতুল। হালকা বৃষ্টি হলেই ড্রেন ভরে রাস্তায় জমে যায় পানি। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত ও পচা পানিতেই চলতে হয়ে পুরান ঢাকাবাসীকে। একই অবস্থা রাজধানীর অন্যান্য এলাকারও। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে নগরীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তা খোঁড়াখুড়ির জন্যও খানা খন্দকের সৃষ্টি হয়ে পানি জমে। রাস্তার এসব গর্তে যানবাহন পড়ে অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে। রাজধানীর পুরান ঢাকায় নানা মৌসুমী ফল ব্যবসা করেন আলি কদম। তিনি বলেন, সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাতে হাঁটু পানি কোমড় পানি জমে যায়। এতে করে আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষদের পড়তে হয় চরম বিপাকে। পানি জমে রাস্তা ঘাট থৈ থৈ করে। দোকান পাট খুলতে পারি না। আমাদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে দ্রুত পানি নামতে পারেনা বলে ভোক্তভোগীরা ঢাকা ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিশেষ করে গত মঙ্গলবার রাতের টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গেছে। গতকাল বুধবার সকাল থেকে কর্মমুখী মানুষকে পড়তে হয়েছে চরম ভোগান্তিতে। বিভিন্ন সড়কে পানিবদ্ধতার কারণে নগরজুড়ে তীব্র যানজটের পাশাপাশি পরিবহন সঙ্কটও দেখা গেছে। সকালে রাজধানীর মতিঝিল, বঙ্গবাজার, পল্টন, নাজিমউদ্দিন রোড ও পুরনো ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এসব এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া মীরপুর, শ্যামলী, কালশী, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নতুন বাজার, খিলক্ষেত, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, বাড্ডা, খিলগাঁও, জুরাইন, পূর্বজুরাইনসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়িতে পানি উঠে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বৃষ্টির কারণে খানাখন্দে ভরা সড়কগুলোতে দুর্বিসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সকালে পরিবহন সঙ্কট দেখা দেওয়ায় অফিসগামী মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। রাজধানীর পানিবদ্ধতা বড় ধরনের সমস্যা হলেও তা নিরসনে এখনও পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদের কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা শান্তিনগরেরর পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে সফলতা পেয়েছি। নাজিমউদ্দিন রোডের পানিবদ্ধতা নিরসনে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আগস্টের মধ্যেই এ কাজ শুরু হবে। এরপর আর কোনও পানিবদ্ধতা থাকবে না। শান্তিনগরে এবছর ৮৫ ভাগ পানিবদ্ধতা কমে গেছে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্যান্য এলাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নগরীতে ভারী বর্ষণ হলে ডিএসসিসির মতিঝিল এলাকায় পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। এ বিষয়ে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, শান্তিনগরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মতিঝিলে আরও একটি প্রকল্প নেওয়া যায় কিনা তা চিন্তাভাবনা করছি। ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন জানান, পানিবদ্ধতা নিরসনে তার সংস্থা থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩১০ কিলোমিটার নর্দমা পরিষ্কার এবং ২৩৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৪০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এ জন্য ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি অত্যাধুনিক জেট অ্যান্ড সাকার মেশিনও কেনা হয়েছে। ডিএসসিসির পূর্ব জুরাইন ও ডিএনডি বাঁধ এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে পাম্পের মাধ্যমে পানি অপসারণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। তবে যেসব এলাকায় পাম্প ও ড্রেন বসবে বেদখল হওয়া সেসব এলাকায় প্রথমে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। এরপর পাম্পের মাধ্যমে পানি সেচ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হবে। ফলে এলাকার পানিবদ্ধতা কমবে বলে মনে করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। যদিও অন্যান্য বছরের মতো এবছরও এই এলাকাবাসীকে পানিবদ্ধতায় দুর্ভোগ পোহাতে হবে। স¤প্রতি ডিএনসিসির বাজেট বক্তৃতায় মেয়র আনিসুল হক বলেন, আমরা পানিবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধার অভিযানে নামছি। এরইমধ্যে ঢাকা ওয়াসা ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছি। কিছু কিছু খালের মধ্যে বহুতল ভবন পর্যন্ত উঠে গেছে। এ পর্যন্ত অন্তত চার শতাধিক ভবন ভেঙে দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে নগরভবনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উত্তর সিটি মেয়র আনিসুল হক বলেন, পানিবদ্ধতা নিরসনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৬৮ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন করা হয়েছে। গত অর্থবছরেও ৩০০ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন করা হয়েছে। পানিবদ্ধতা নিরসনে দুই সিট কর্পোরেশনে প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি অত্যাধুনিক জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন যুক্ত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই যন্ত্রটি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা কাজ করতে পারবে। প্রতি ১০ মিনিটের মধ্যে ১২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা যাবে। কিন্তু, দুই মেয়র, সিটি কর্পোরেশন আর ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তাদের এত আশ্বাস ও কর্মসূচির পরেও পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নগরবাসী। এখনও সামান্য বৃষ্টি হলেই মিরপুর, কালশী, কারওয়ান বাজার, কুড়িল, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় জমে যাচ্ছে থৈ থৈ পানি। মূলত পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ১৯৮৯ সালে সংস্থাটিকে পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি একাজে যুক্ত হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব পালন করলেও ঢাকা ওয়াসা তার মূল দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে এখন কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। ওয়াসার এই ব্যর্থতার দায় যাচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের ওপরে। এ জন্য দুই সিটি কর্পোরেশন ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থা তাদের অধীনে নিতে চায়। এ বিষয়ে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা ড্রেনের দায়িত্ব নিতে চাই, তবে তা ঠিক করে দিতে হবে। জনবল দিতে হবে। আমরা এর রক্ষণাবেক্ষণ করবো। আর আনিসুল হক বলেন, আমরা ওয়াসার ড্রেন নেবো। এ নিয়ে শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হবে। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ওয়াসা থেকে জানানো হয়, শুধু ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণেই যে ঢাকায় পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তা কিন্তু নয়। এর পিছনে আরও অনেকগুলো কারণ রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার প্রায় ৬৭টি খালের মধ্যে আমরা ২৬ খালের দেখাশুনা করি। বাকি খালগুলোর অবস্থা ব্যহাল। যে ২৬টি খাল দেখাশুনা ওয়াসা করে সেগুলোও অর্থনৈতিক ও লোকবলের অভবে নিয়মিত খনন ও পরিস্কার করা যাচ্ছে না। এছাড়াও দখলদারদের উৎপাত তো রয়েছেই। শুধু মাত্র ওয়াসার একক চেষ্টায় ঢাকা শহরের এ সমস্যার দুর করা সম্ভব নয়। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য নরগবাসীকেও সহযোগীতা করতে হবে। সরজমিন দেখা গেছে, দুপুর ১টার পর বৃষ্টির প্রকোপ কিছুটা কম আসে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে কাজীপাড়া থেকে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত শত শত মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু গণপরিবহনের দেখা নেই। সিএনজি অটোরিকশা সোনার হরিণ। রিকশা পাওয়া গেলেও ভাড়া আকাশচুম্বী। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে রাস্তার দুই ধারে আর গলিতে জমে থাকা পানি নগরবাসীর দুর্ভোগের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। কেবল বেগম রোকেয়া সরণির কাজীপাড়া বা শেওড়াপাড়া নয়, সকাল থেকে টানা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে রাজধানীর অনেক এলাকার রাস্তাঘাট। বিভিন্ন গলিপথে জমে গেছে পানি। রাস্তায় পানির কারণে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ভীষণ ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। রাজধানীর দক্ষিণ দনিয়া এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই রস্তায় পানি জমে যায়। বিশেষ করে বর্ণমালা স্কুলের সামনে থেকে পশ্চিমে গোয়ালবাড়ী মোড় পর্যন্ত কোমর পানি জমে মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তবে পানিবদ্ধতায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাচ্ছেন যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর থানার বাসিন্দারা। এ দুই থানার বেশিরভাগ এলাকা পানিবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সরজমিন দেখা গেছে, মাতুয়াইল, কোনাপাড়া, গোবিন্দপুর, শেখদী, দনিয়াসহ কয়েকটি এলাকার রাস্তা পানিতে তলিয়ে আছে। মাতুয়াইল কবরস্থান রোড়ের বাসিন্দা এয়ার আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, আমার বাড়ির সামনে হাঁটুপানি জমে গেছে। চলাচলে খুবই অসুবিধা হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই খানবাড়ি মোড় থেকে কবরস্থান যাওয়ার রাস্তাটি পানিতে তলিয়ে যায়। গতকাল ব্যাংক পাড়া মতিঝিলের বনশিল্প ভবন ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আশপাশে দেখা গেছে হাঁটু পানি। গতকাল ও এর আগের দিনের বৃষ্টিপাতে প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে রাজধানী। সময় মত পানি নেমে না যাওয়ায় প্রধান প্রধান সড়কে পানি জমে গেছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়গুলোতে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় গাড়ি চলাচলেও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও সড়কের ম্যানহোলের ঢাকনা না থাকায় অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। আবার পানিবদ্ধতার কারণে কোথাও কোথাও যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। শান্তিনগরে একটি জরুরি ওষধ সরবরাহকারী পিকআপ ভ্যান বিকল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। একটু বৃষ্টি হলেই রাজধানীতে পানি জমে যাওয়া নতুন কিছু নয়। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর রাস্তায় পানি জমে যায়। রাজধানীবাসী এ অভিযোগ বহুদিনের। এ যেন দেখার কেউ নেই অবস্থা।
গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলি গলি পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। চরম ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। অফিস যাত্রী, স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীসহ অন্য সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে সকাল থেকেই নানা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে পড়তে হয়েছে দুর্ভোগে। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে অনেকেরই অফিসে যেতে হয়েছে। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় হাঁটুপানি জমে যাওয়ায় নগরীর সর্বত্র প্রচন্ড যানজটের সৃষ্টি হয়। ভয়াবহ এ যানজটের কারণে সময়ের অনেক আগে ঘর থেকে বের হয়েও কেওই সময় মতো অফিস, আদালত, স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পারেনি। যানবাহনের অপেক্ষায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আর কোন উপায় ছিল না।
দীর্ঘদিন ধরে ড্রেনেজ ব্যবস্থার কোন সংস্কার না করা এবং কোন কোন এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সর্বত্রই পানিতে ডুবে যায়। ডিএনডি বাঁধ এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই হাঁটু পানি জমে। এই এলাকায় নেই কোন ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ফলে বৃষ্টির পানি জমে থাকলেও সরে যাওয়ার কোন পথ থাকে না। তাই দিনের পর দিন হাটু পানিতেই চলাচল করতে হয় ওই এলাকার মানুষকে। পুরান ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা সবচেয়ে অপ্রতুল। হালকা বৃষ্টি হলেই ড্রেন ভরে রাস্তায় জমে যায় পানি। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত ও পচা পানিতেই চলতে হয়ে পুরান ঢাকাবাসীকে। একই অবস্থা রাজধানীর অন্যান্য এলাকারও। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে নগরীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তা খোঁড়াখুড়ির জন্যও খানা খন্দকের সৃষ্টি হয়ে পানি জমে। রাস্তার এসব গর্তে যানবাহন পড়ে অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে।
রাজধানীর পুরান ঢাকায় নানা মৌসুমী ফল ব্যবসা করেন আলি কদম। তিনি বলেন, সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাতে হাঁটু পানি কোমড় পানি জমে যায়। এতে করে আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষদের পড়তে হয় চরম বিপাকে। পানি জমে রাস্তা ঘাট থৈ থৈ করে। দোকান পাট খুলতে পারি না। আমাদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে দ্রুত পানি নামতে পারেনা বলে ভোক্তভোগীরা ঢাকা ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বিশেষ করে গত মঙ্গলবার রাতের টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গেছে। গতকাল বুধবার সকাল থেকে কর্মমুখী মানুষকে পড়তে হয়েছে চরম ভোগান্তিতে। বিভিন্ন সড়কে পানিবদ্ধতার কারণে নগরজুড়ে তীব্র যানজটের পাশাপাশি পরিবহন সঙ্কটও দেখা গেছে।
সকালে রাজধানীর মতিঝিল, বঙ্গবাজার, পল্টন, নাজিমউদ্দিন রোড ও পুরনো ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এসব এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া মীরপুর, শ্যামলী, কালশী, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নতুন বাজার, খিলক্ষেত, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, বাড্ডা, খিলগাঁও, জুরাইন, পূর্বজুরাইনসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়িতে পানি উঠে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বৃষ্টির কারণে খানাখন্দে ভরা সড়কগুলোতে দুর্বিসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সকালে পরিবহন সঙ্কট দেখা দেওয়ায় অফিসগামী মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। রাজধানীর পানিবদ্ধতা বড় ধরনের সমস্যা হলেও তা নিরসনে এখনও পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদের কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা শান্তিনগরেরর পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে সফলতা পেয়েছি। নাজিমউদ্দিন রোডের পানিবদ্ধতা নিরসনে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আগস্টের মধ্যেই এ কাজ শুরু হবে। এরপর আর কোনও পানিবদ্ধতা থাকবে না। শান্তিনগরে এবছর ৮৫ ভাগ পানিবদ্ধতা কমে গেছে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্যান্য এলাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নগরীতে ভারী বর্ষণ হলে ডিএসসিসির মতিঝিল এলাকায় পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। এ বিষয়ে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, শান্তিনগরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মতিঝিলে আরও একটি প্রকল্প নেওয়া যায় কিনা তা চিন্তাভাবনা করছি।
ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন জানান, পানিবদ্ধতা নিরসনে তার সংস্থা থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩১০ কিলোমিটার নর্দমা পরিষ্কার এবং ২৩৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৪০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এ জন্য ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি অত্যাধুনিক জেট অ্যান্ড সাকার মেশিনও কেনা হয়েছে।
ডিএসসিসির পূর্ব জুরাইন ও ডিএনডি বাঁধ এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে পাম্পের মাধ্যমে পানি অপসারণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। তবে যেসব এলাকায় পাম্প ও ড্রেন বসবে বেদখল হওয়া সেসব এলাকায় প্রথমে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। এরপর পাম্পের মাধ্যমে পানি সেচ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হবে। ফলে এলাকার পানিবদ্ধতা কমবে বলে মনে করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। যদিও অন্যান্য বছরের মতো এবছরও এই এলাকাবাসীকে পানিবদ্ধতায় দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
স¤প্রতি ডিএনসিসির বাজেট বক্তৃতায় মেয়র আনিসুল হক বলেন, আমরা পানিবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধার অভিযানে নামছি। এরইমধ্যে ঢাকা ওয়াসা ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছি। কিছু কিছু খালের মধ্যে বহুতল ভবন পর্যন্ত উঠে গেছে। এ পর্যন্ত অন্তত চার শতাধিক ভবন ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে নগরভবনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উত্তর সিটি মেয়র আনিসুল হক বলেন, পানিবদ্ধতা নিরসনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৬৮ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন করা হয়েছে। গত অর্থবছরেও ৩০০ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন করা হয়েছে। পানিবদ্ধতা নিরসনে দুই সিট কর্পোরেশনে প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি অত্যাধুনিক জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন যুক্ত করা হয়েছে।
বলা হচ্ছে, এই যন্ত্রটি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা কাজ করতে পারবে। প্রতি ১০ মিনিটের মধ্যে ১২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা যাবে। কিন্তু, দুই মেয়র, সিটি কর্পোরেশন আর ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তাদের এত আশ্বাস ও কর্মসূচির পরেও পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নগরবাসী। এখনও সামান্য বৃষ্টি হলেই মিরপুর, কালশী, কারওয়ান বাজার, কুড়িল, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় জমে যাচ্ছে থৈ থৈ পানি।
মূলত পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ১৯৮৯ সালে সংস্থাটিকে পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি একাজে যুক্ত হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব পালন করলেও ঢাকা ওয়াসা তার মূল দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে এখন কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। ওয়াসার এই ব্যর্থতার দায় যাচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের ওপরে। এ জন্য দুই সিটি কর্পোরেশন ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থা তাদের অধীনে নিতে চায়।
এ বিষয়ে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা ড্রেনের দায়িত্ব নিতে চাই, তবে তা ঠিক করে দিতে হবে। জনবল দিতে হবে। আমরা এর রক্ষণাবেক্ষণ করবো। আর আনিসুল হক বলেন, আমরা ওয়াসার ড্রেন নেবো। এ নিয়ে শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হবে। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ওয়াসা থেকে জানানো হয়, শুধু ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণেই যে ঢাকায় পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তা কিন্তু নয়। এর পিছনে আরও অনেকগুলো কারণ রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার প্রায় ৬৭টি খালের মধ্যে আমরা ২৬ খালের দেখাশুনা করি। বাকি খালগুলোর অবস্থা ব্যহাল। যে ২৬টি খাল দেখাশুনা ওয়াসা করে সেগুলোও অর্থনৈতিক ও লোকবলের অভবে নিয়মিত খনন ও পরিস্কার করা যাচ্ছে না। এছাড়াও দখলদারদের উৎপাত তো রয়েছেই। শুধু মাত্র ওয়াসার একক চেষ্টায় ঢাকা শহরের এ সমস্যার দুর করা সম্ভব নয়। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য নরগবাসীকেও সহযোগীতা করতে হবে।
সরজমিন দেখা গেছে, দুপুর ১টার পর বৃষ্টির প্রকোপ কিছুটা কম আসে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে কাজীপাড়া থেকে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত শত শত মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু গণপরিবহনের দেখা নেই। সিএনজি অটোরিকশা সোনার হরিণ। রিকশা পাওয়া গেলেও ভাড়া আকাশচুম্বী। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে রাস্তার দুই ধারে আর গলিতে জমে থাকা পানি নগরবাসীর দুর্ভোগের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।
কেবল বেগম রোকেয়া সরণির কাজীপাড়া বা শেওড়াপাড়া নয়, সকাল থেকে টানা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে রাজধানীর অনেক এলাকার রাস্তাঘাট। বিভিন্ন গলিপথে জমে গেছে পানি। রাস্তায় পানির কারণে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ভীষণ ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী।
রাজধানীর দক্ষিণ দনিয়া এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই রস্তায় পানি জমে যায়। বিশেষ করে বর্ণমালা স্কুলের সামনে থেকে পশ্চিমে গোয়ালবাড়ী মোড় পর্যন্ত কোমর পানি জমে মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
তবে পানিবদ্ধতায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাচ্ছেন যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর থানার বাসিন্দারা। এ দুই থানার বেশিরভাগ এলাকা পানিবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সরজমিন দেখা গেছে, মাতুয়াইল, কোনাপাড়া, গোবিন্দপুর, শেখদী, দনিয়াসহ কয়েকটি এলাকার রাস্তা পানিতে তলিয়ে আছে।
মাতুয়াইল কবরস্থান রোড়ের বাসিন্দা এয়ার আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, আমার বাড়ির সামনে হাঁটুপানি জমে গেছে। চলাচলে খুবই অসুবিধা হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই খানবাড়ি মোড় থেকে কবরস্থান যাওয়ার রাস্তাটি পানিতে তলিয়ে যায়।
গতকাল ব্যাংক পাড়া মতিঝিলের বনশিল্প ভবন ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আশপাশে দেখা গেছে হাঁটু পানি। গতকাল ও এর আগের দিনের বৃষ্টিপাতে প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে রাজধানী। সময় মত পানি নেমে না যাওয়ায় প্রধান প্রধান সড়কে পানি জমে গেছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়গুলোতে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় গাড়ি চলাচলেও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও সড়কের ম্যানহোলের ঢাকনা না থাকায় অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। আবার পানিবদ্ধতার কারণে কোথাও কোথাও যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। শান্তিনগরে একটি জরুরি ওষধ সরবরাহকারী পিকআপ ভ্যান বিকল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। একটু বৃষ্টি হলেই রাজধানীতে পানি জমে যাওয়া নতুন কিছু নয়। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর রাস্তায় পানি জমে যায়। রাজধানীবাসী এ অভিযোগ বহুদিনের। এ যেন দেখার কেউ নেই অবস্থা।রাজধানীর সড়কগুলোতে থৈ থৈ করছে পানি। সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু পানি জমে ঢাকার রাজপথ নদীতে পরিণত হয়। রাজপথের এ নদী দিয়ে কৃষকের ধানভর্তি পাল তোলা নৌকা পারাপারের দৃশ্য চোখে না পড়লেও পানির মধ্য দিয়ে গাড়ি চলাচলের মহা দুর্ভোগের দৃশ্য এখন নগরবাসীর কাছে অতি পরিচিত। একটু বৃষ্টি হলেই রাজপথ থেকে গলি পথ পানিতে একাকার হয়ে যায়। এতে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলি গলি পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। চরম ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। অফিস যাত্রী, স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীসহ অন্য সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে সকাল থেকেই নানা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে পড়তে হয়েছে দুর্ভোগে। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে অনেকেরই অফিসে যেতে হয়েছে। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় হাঁটুপানি জমে যাওয়ায় নগরীর সর্বত্র প্রচন্ড যানজটের সৃষ্টি হয়। ভয়াবহ এ যানজটের কারণে সময়ের অনেক আগে ঘর থেকে বের হয়েও কেওই সময় মতো অফিস, আদালত, স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পারেনি। যানবাহনের অপেক্ষায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আর কোন উপায় ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেনেজ ব্যবস্থার কোন সংস্কার না করা এবং কোন কোন এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সর্বত্রই পানিতে ডুবে যায়। ডিএনডি বাঁধ এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই হাঁটু পানি জমে। এই এলাকায় নেই কোন ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ফলে বৃষ্টির পানি জমে থাকলেও সরে যাওয়ার কোন পথ থাকে না। তাই দিনের পর দিন হাটু পানিতেই চলাচল করতে হয় ওই এলাকার মানুষকে। পুরান ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা সবচেয়ে অপ্রতুল। হালকা বৃষ্টি হলেই ড্রেন ভরে রাস্তায় জমে যায় পানি। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত ও পচা পানিতেই চলতে হয়ে পুরান ঢাকাবাসীকে। একই অবস্থা রাজধানীর অন্যান্য এলাকারও। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে নগরীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তা খোঁড়াখুড়ির জন্যও খানা খন্দকের সৃষ্টি হয়ে পানি জমে। রাস্তার এসব গর্তে যানবাহন পড়ে অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে। রাজধানীর পুরান ঢাকায় নানা মৌসুমী ফল ব্যবসা করেন আলি কদম। তিনি বলেন, সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাতে হাঁটু পানি কোমড় পানি জমে যায়। এতে করে আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষদের পড়তে হয় চরম বিপাকে। পানি জমে রাস্তা ঘাট থৈ থৈ করে। দোকান পাট খুলতে পারি না। আমাদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে দ্রুত পানি নামতে পারেনা বলে ভোক্তভোগীরা ঢাকা ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিশেষ করে গত মঙ্গলবার রাতের টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গেছে। গতকাল বুধবার সকাল থেকে কর্মমুখী মানুষকে পড়তে হয়েছে চরম ভোগান্তিতে। বিভিন্ন সড়কে পানিবদ্ধতার কারণে নগরজুড়ে তীব্র যানজটের পাশাপাশি পরিবহন সঙ্কটও দেখা গেছে। সকালে রাজধানীর মতিঝিল, বঙ্গবাজার, পল্টন, নাজিমউদ্দিন রোড ও পুরনো ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এসব এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া মীরপুর, শ্যামলী, কালশী, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নতুন বাজার, খিলক্ষেত, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, বাড্ডা, খিলগাঁও, জুরাইন, পূর্বজুরাইনসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়িতে পানি উঠে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বৃষ্টির কারণে খানাখন্দে ভরা সড়কগুলোতে দুর্বিসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সকালে পরিবহন সঙ্কট দেখা দেওয়ায় অফিসগামী মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। রাজধানীর পানিবদ্ধতা বড় ধরনের সমস্যা হলেও তা নিরসনে এখনও পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদের কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা শান্তিনগরেরর পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে সফলতা পেয়েছি। নাজিমউদ্দিন রোডের পানিবদ্ধতা নিরসনে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আগস্টের মধ্যেই এ কাজ শুরু হবে। এরপর আর কোনও পানিবদ্ধতা থাকবে না। শান্তিনগরে এবছর ৮৫ ভাগ পানিবদ্ধতা কমে গেছে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্যান্য এলাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নগরীতে ভারী বর্ষণ হলে ডিএসসিসির মতিঝিল এলাকায় পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। এ বিষয়ে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, শান্তিনগরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মতিঝিলে আরও একটি প্রকল্প নেওয়া যায় কিনা তা চিন্তাভাবনা করছি। ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন জানান, পানিবদ্ধতা নিরসনে তার সংস্থা থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩১০ কিলোমিটার নর্দমা পরিষ্কার এবং ২৩৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৪০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এ জন্য ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি অত্যাধুনিক জেট অ্যান্ড সাকার মেশিনও কেনা হয়েছে। ডিএসসিসির পূর্ব জুরাইন ও ডিএনডি বাঁধ এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে পাম্পের মাধ্যমে পানি অপসারণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। তবে যেসব এলাকায় পাম্প ও ড্রেন বসবে বেদখল হওয়া সেসব এলাকায় প্রথমে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। এরপর পাম্পের মাধ্যমে পানি সেচ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হবে। ফলে এলাকার পানিবদ্ধতা কমবে বলে মনে করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। যদিও অন্যান্য বছরের মতো এবছরও এই এলাকাবাসীকে পানিবদ্ধতায় দুর্ভোগ পোহাতে হবে। স¤প্রতি ডিএনসিসির বাজেট বক্তৃতায় মেয়র আনিসুল হক বলেন, আমরা পানিবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধার অভিযানে নামছি। এরইমধ্যে ঢাকা ওয়াসা ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছি। কিছু কিছু খালের মধ্যে বহুতল ভবন পর্যন্ত উঠে গেছে। এ পর্যন্ত অন্তত চার শতাধিক ভবন ভেঙে দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে নগরভবনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উত্তর সিটি মেয়র আনিসুল হক বলেন, পানিবদ্ধতা নিরসনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৬৮ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন করা হয়েছে। গত অর্থবছরেও ৩০০ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন করা হয়েছে। পানিবদ্ধতা নিরসনে দুই সিট কর্পোরেশনে প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি অত্যাধুনিক জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন যুক্ত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই যন্ত্রটি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা কাজ করতে পারবে। প্রতি ১০ মিনিটের মধ্যে ১২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা যাবে। কিন্তু, দুই মেয়র, সিটি কর্পোরেশন আর ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তাদের এত আশ্বাস ও কর্মসূচির পরেও পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নগরবাসী। এখনও সামান্য বৃষ্টি হলেই মিরপুর, কালশী, কারওয়ান বাজার, কুড়িল, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় জমে যাচ্ছে থৈ থৈ পানি। মূলত পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ১৯৮৯ সালে সংস্থাটিকে পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি একাজে যুক্ত হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব পালন করলেও ঢাকা ওয়াসা তার মূল দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে এখন কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। ওয়াসার এই ব্যর্থতার দায় যাচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের ওপরে। এ জন্য দুই সিটি কর্পোরেশন ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থা তাদের অধীনে নিতে চায়। এ বিষয়ে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা ড্রেনের দায়িত্ব নিতে চাই, তবে তা ঠিক করে দিতে হবে। জনবল দিতে হবে। আমরা এর রক্ষণাবেক্ষণ করবো। আর আনিসুল হক বলেন, আমরা ওয়াসার ড্রেন নেবো। এ নিয়ে শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হবে। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ওয়াসা থেকে জানানো হয়, শুধু ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণেই যে ঢাকায় পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তা কিন্তু নয়। এর পিছনে আরও অনেকগুলো কারণ রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার প্রায় ৬৭টি খালের মধ্যে আমরা ২৬ খালের দেখাশুনা করি। বাকি খালগুলোর অবস্থা ব্যহাল। যে ২৬টি খাল দেখাশুনা ওয়াসা করে সেগুলোও অর্থনৈতিক ও লোকবলের অভবে নিয়মিত খনন ও পরিস্কার করা যাচ্ছে না। এছাড়াও দখলদারদের উৎপাত তো রয়েছেই। শুধু মাত্র ওয়াসার একক চেষ্টায় ঢাকা শহরের এ সমস্যার দুর করা সম্ভব নয়। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য নরগবাসীকেও সহযোগীতা করতে হবে। সরজমিন দেখা গেছে, দুপুর ১টার পর বৃষ্টির প্রকোপ কিছুটা কম আসে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে কাজীপাড়া থেকে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত শত শত মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু গণপরিবহনের দেখা নেই। সিএনজি অটোরিকশা সোনার হরিণ। রিকশা পাওয়া গেলেও ভাড়া আকাশচুম্বী। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে রাস্তার দুই ধারে আর গলিতে জমে থাকা পানি নগরবাসীর দুর্ভোগের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। কেবল বেগম রোকেয়া সরণির কাজীপাড়া বা শেওড়াপাড়া নয়, সকাল থেকে টানা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে রাজধানীর অনেক এলাকার রাস্তাঘাট। বিভিন্ন গলিপথে জমে গেছে পানি। রাস্তায় পানির কারণে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ভীষণ ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। রাজধানীর দক্ষিণ দনিয়া এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই রস্তায় পানি জমে যায়। বিশেষ করে বর্ণমালা স্কুলের সামনে থেকে পশ্চিমে গোয়ালবাড়ী মোড় পর্যন্ত কোমর পানি জমে মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তবে পানিবদ্ধতায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাচ্ছেন যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর থানার বাসিন্দারা। এ দুই থানার বেশিরভাগ এলাকা পানিবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সরজমিন দেখা গেছে, মাতুয়াইল, কোনাপাড়া, গোবিন্দপুর, শেখদী, দনিয়াসহ কয়েকটি এলাকার রাস্তা পানিতে তলিয়ে আছে। মাতুয়াইল কবরস্থান রোড়ের বাসিন্দা এয়ার আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, আমার বাড়ির সামনে হাঁটুপানি জমে গেছে। চলাচলে খুবই অসুবিধা হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই খানবাড়ি মোড় থেকে কবরস্থান যাওয়ার রাস্তাটি পানিতে তলিয়ে যায়। গতকাল ব্যাংক পাড়া মতিঝিলের বনশিল্প ভবন ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আশপাশে দেখা গেছে হাঁটু পানি। গতকাল ও এর আগের দিনের বৃষ্টিপাতে প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে রাজধানী। সময় মত পানি নেমে না যাওয়ায় প্রধান প্রধান সড়কে পানি জমে গেছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়গুলোতে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় গাড়ি চলাচলেও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও সড়কের ম্যানহোলের ঢাকনা না থাকায় অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। আবার পানিবদ্ধতার কারণে কোথাও কোথাও যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। শান্তিনগরে একটি জরুরি ওষধ সরবরাহকারী পিকআপ ভ্যান বিকল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। একটু বৃষ্টি হলেই রাজধানীতে পানি জমে যাওয়া নতুন কিছু নয়। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর রাস্তায় পানি জমে যায়। রাজধানীবাসী এ অভিযোগ বহুদিনের। এ যেন দেখার কেউ নেই অবস্থা।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ