২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১:৩১

শবে-বরাতের ফযীলত

নিজস্ব প্রতিবেদক:

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বছরের কোনো কোনো মাস, দিন ও রাত্রিকে ইবাদতের জন্য বিশেষভাবে বরকতময় ও বৈশিষ্টমণ্ডিত করে দিয়েছেন৷ বরকতময় এ সময়গুলোতে সামান্য মেহনত ও প্রচেষ্টার ফলে বিশাল প্রতিদানের অধিকারী হওয়া যায়, যা অন্য সময় অধিক মেহনত করেও অর্জন করা সম্ভব নয়৷ সেই সময়গুলোর মধ্যে শবে-বরাত অন্যতম৷

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো মহান এ রাতটি বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির শিকার৷ সমাজের একটি বড় অংশ এ রাতকে কেন্দ্র করে অনেক প্রকার বিদ’আতি প্রথাপালনে লিপ্ত হয়- যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। আর কেউ কেউ রাতটির ফযীলতকেই পুরোপুরি অস্বীকার করে বলছে এ রাতের ফযীলত কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়- তাদের এ দাবীও যথাযথ নয়। তাই এ নিবন্ধে শবে-বরাতের ফযিলত সম্বন্ধে কয়েকটি নির্ভরযোগ্য হাদিস আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

১ম হাদীস-

عن معاذ بن جبل رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مساحن.

অর্থ: হযরত মু’আজ ইবনে জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা’আলা অর্ধ শা’বানের রাতে (শবে-বরাতে) তাঁর সৃষ্টির প্রতি মনোযোগী হন এবং মুশরিক ও বিদ্ধেষ পোষণকারী ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন৷ (সহীহ্ ইবনে হিব্বান, হাদীস: ৫৬৬৫, সুনানে ইবনে মাযাহ্, হাদীস: ১৩৯০, মুসান্নাফু ইবনে আবী শাইবাহ, হাদীস: ৩০৪৭৯, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস: ৬২০৪)

হাদীসটির সনদ সম্পর্কে কিছু কথা:

হাদীসটির সনদ সহীহ্৷ এজন্যই ইমাম ইবনে হিব্বান হাদীসটিকে “কিতাবুস সহীহ্” এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন৷ যদি শবে-বরাতের ফজীলত সম্বন্ধে দ্বিতীয় কোনো হাদীস না থাকতো, তবে এই একটি হাদীস-ই এ রাতের ফযীলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হতো৷ অথচ হাদীসের কিতাব সমূহে নির্ভরযোগ্য সনদে এ বিষয়ক আরও একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে৷

ইমাম মুনযিরী, ইবনে রযব, নূরুদ্দীন হাইসামী, কাসতালানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদগণ এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলেছেন৷ দেখুন- কিতাবুস্ সুন্নাহ্, ১/২২৪, আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব, ২/২৪১, ৪/২৩৮, মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ৮/৬৫, শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা, ১০/৫৬১

এছাড়া শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহিমাহুল্লাহ “সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহাহ” ৩/১৩৫-১৩৯- এ এই হাদীসের সমর্থনে আরো আটটি হাদীস উল্লেখ করে লিখেন-

و جملة القول أم الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب و الصحة تثبت بأقل منها عددا ما دامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديث.

অর্থ: “এ সব বর্ণনার মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এই হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ্ প্রমাণিত হয় ৷ আর সহীহ্ হওয়া এর থেকে কম সংখ্যক বর্ণনার দ্বারাও প্রমাণিত হয়ে যায়, যতক্ষণ তা মারাত্মক কোনো দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকে, যেমন এই হাদীসটি৷”

শাইখ আলবানী রহিমাহুল্লাহ এর উক্ত বিশ্লেষণ থেকেও নির্দ্বিধায় হাদীস দ্বারা শবে-বরাত প্রমাণিত হয়৷ সুতরাং এ কথা বলার কোনোই সুযোগ নেই যে- শবে বরাত কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়৷

২য় হাদীস-

عن علي بن أبي طالب رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها و صوموا نهارها فإن الله ينزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا فيقول ألا من مستغفر لي فأغفر له ألا مسترزق فأرزق له ألا مبتلىً فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر.

অর্থ: হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- অর্ধ শা’বানের রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত করে কাটাও এবং দিনে রোযা রাখো৷ নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা এ রাতে সূর্যাস্তের পর প্রথম আসমানে আসেন এবং বলতে থাকেন, আছে কী কোনো ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করবো৷ আছে কি কোনো রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দিবো৷ আছে কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দিব৷ আছে কি এমন, আছে কি এমন, – এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত বলতে থাকেন৷ (সুনানে ইবনে মাযাহ, হাদীস: ২৩৮৪, শু’আবুল ঈমান, হাদীস: ৩৮২২, আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব: ২/১৩৩)

সনদ বিচারে হাদীসটির মান:

এই বর্ণনাটির সনদ যয়ীফ৷ হাদীস বিশারদদের সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত হলো- ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদীসও গ্রহণযোগ্য৷ তাছাড়া শা’বান মাসে বেশি বেশি নফল রোযা রাখার কথা সহীহ্ হাদীসে এসেছে এবং আইয়ামে বীয অর্থাৎ প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার বিষয়টিও সহীহ্ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত৷

৩য় হাদীস-

হযরত আ’লা ইবনুল হারিস রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন- একবার রাসূলুল্লাহ সা. রাতে নামাযে দাঁড়ালেন এবং এতো দীর্ঘ সিজদা করলেন যে, আমার আশঙ্কা হলো তাঁর ইন্তেকাল হয়ে গেছে৷ আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম৷ যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে বললেন, হে আয়েশা! অথবা বললেন, হে হুমায়রা! তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম- না ইয়া রসূলাল্লাহ৷ আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার এ আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না! নবী কারীম সা. বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন্ রাত? আমি বললাম, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন৷ তিনি তখন বললেন-

هذه ليلة النصف من شعبان إن الله عز و جل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان فيغفر للمستغفرين و يرحم المسترحمين و يؤخر اهل الحقد كما هم.

অর্থ: “এটা হলো অর্ধ শা’বানের রাত৷ (শা’বানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত) ৷ আল্লাহ তা’আলা অর্ধ শা’বানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি মনযোগ দেন, ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের উপর অনুগ্রহ করেন৷ আর বিদ্বেষ পেষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।”

ইমামা বাইহাকী রহিমাহুল্লাহ এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যপারে বলেছেন- هذا مرسل جيد [হাদীসটি মুরসাল তবে তার সনদ সেরা, উৎকৃষ্ট ৷] আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে প্রচলিত সমস্ত বিদ’আতি প্রথা পরিহার করে এ রাতকে এ রাতের মত করে মুল্যায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

দৈনিকদেশজনতা/ আই সি

প্রকাশ :মে ১, ২০১৮ ২:০৪ অপরাহ্ণ