দৈনিক দেশজনতা অনলাইন ডেস্ক:
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রোববার সকাল থেকে কালবৈশাখীর তাণ্ডব চলে। সেই সঙ্গে ছিল অস্বাভাবিক মাত্রার বৃষ্টি ও বজ্রপাত। সকাল থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত বজ্রপাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এ মৌসুমি বজ্রপাতে ১ দিনে এটাই সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। এ সময়ে আহত হয়েছেন অন্তত ১৪ জন। আরও দু-এক দিন কালবৈশাখী সমানতালে আঘাত হানতে পারে। বিশেষ করে ১৮ জেলায় ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বা তারও বেশি বেগে ঝড়ো হাওয়াসহ কালবৈশাখী বয়ে যেতে পারে বলে ইতিমধ্যে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ (বিএমডি)। এর প্রভাবে দেশের নদ-নদীগুলো উত্তাল হয়ে উঠেছে। ওইসব এলাকার নদী বন্দরগুলোতে ২ নম্বর নৌ হুশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
বুয়েটের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। পৃথিবীতে যত মানুষ মারা যান তার এক-চতুর্থাংশ মারা যান এ দেশে। সতর্কতামূলক পদক্ষেপ এবং প্রকৃতিকে ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই এ দুর্যোগে মৃত্যু হার কমানো সম্ভব। তিনি বলেন, নানা পদক্ষেপ নেয়া যায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে মোবাইল টেকনোলজির মাধ্যমে বজ্রপাতের ৩০-৪৫ মিনিট আগে জনগণকে এসএমএস পাঠিয়ে সতর্ক করা। এ পদক্ষেপ নিয়ে ভারতের কর্নাটক সুফল পেয়েছে।
বজ্রপাতে মৃত্যুসহ দুর্যোগের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ ও খোঁজখবর রাখতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় ওই কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা জানান, সকাল থেকে ৭ জেলায় ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন তারা। এ বছর এখন পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি কিশোরগঞ্জে। তবে সে সংখ্যা ওই কর্মকর্তা জানাতে পারেননি।
দেশি-বিদেশি গবেষণা অনুযায়ী, দেশে গত কয়েক বছরে কালবৈশাখীর পাশাপাশি বজ্রপাতের হার বেড়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালে শুধু এপ্রিল-মে মাসেই বজ্রপাত বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। হাওর এবং উপকূলীয় এলাকায় এর মাত্রা আরও কয়েকগুণ বেশি। বজ্রপাতে মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৩০১ জন মারা গেছেন বজ্রপাতে। এভাবে ২০১০ সালে ১২৪ জন, ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ৩০১ জন, ২০১৩ সালে ২৮৫ জন, ২০১৪ সালে ২১০ জন, ২০১৫ সালে ২৭৪ জন এবং ২০১৬ সালে প্রায় ৩৫০ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩ হতে ২০১৬ পর্যন্ত সংখ্যার যথাক্রমে ১২৮ জন, ৭৯ জন, ৯১ জন ও ১৩২ জন শুধু এপ্রিল-মে মাসেই বজ্রপাতে মারা গেছেন। বুয়েটের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সাইফুল বলেন, ২০১৬ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর এমন ঘটনার পরই ওই বছর ১৭ মে সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে।
বজ্রপাত বা এ ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে একক কোনো কারণ চিহ্নিত করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, আবহাওয়া অধিদফতর (বিএমডি) সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগে অনেকটাই ধারণানির্ভর তথ্য জানা গেছে। তারা মনে করছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বাতাসে সিসার পরিমাণ বাড়া, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহারের আধিক্য, মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, এসব কারণের প্রায় সবগুলোর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের সম্পর্ক আছে। বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, বিশ্বখ্যাত সায়েন্স পত্রিকার এক নিবন্ধে ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১২ শতাংশ বেড়ে যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, দেশে সাধারণত বর্ষা আসার আগের মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রা বেশি হারে বাড়ে। এতে এ সময়ে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসা আর্র্দ্র বায়ু আর উত্তরে আরব সাগর থেকে আসা শুষ্ক বায়ুর মিলনে বজ্র ঝড় সৃষ্টি হচ্ছে। এ ঝড় দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ধাবিত হয়। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, সাধারণত বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮-১০টা পর্যন্ত কালবৈশাখী ঝড় হয়। আবার ভোররাত ৪টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্তও কালবৈশাখী বয়ে যায়। এ সময়ে ঝড়ের সঙ্গে বজ্রপাত হয়।
বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, বজ্রপাতে মৃত্যুর ৯৯ শতাংশই ঘটেছে বাইরে খোলা আকাশের নিচে থাকার কারণে। তাই একটু সচেতনতাই পারে এ মৃত্যু ঠেকাতে। তিনি পরামর্শ দেন- যখনই আকাশ একটু মেঘলা দেখা যাবে, তখনই যথাসম্ভব খোলা আকাশের নিচ থেকে চলে আসতে হবে। বড় গাছ, টিনের ঘর, বৈদ্যুতিক খুঁটি ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। পারলে ইটের বা মাটির ঘরে ও ছাদের নিচে চলে আসতে হবে। মোবাইল ফোন, ফ্রিজ, টিভি ইত্যাদি বন্ধ করে দিতে হবে। এ প্রচারণা চালাতে দুর্যোগ অধিদফতর কাজ করছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইসলাম বলেন, সচেতনতা, সতর্কতা, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলাজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এ ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, হাওরাঞ্চলে আর্দ্রতা বেশি। আর উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি। এ কারণে এ দুই অঞ্চলে বজ্রপাত বেশি হওয়ার কারণ হতে পারে। তবে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাসে তিন দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যায়। ভারতের কর্নাটকে ৩০-৪৫ মিনিট আগে সতর্কতামূলক এসএমএস দেয়া হচ্ছে। ভিয়েতনামে টাওয়ার স্থাপনের মাধ্যমে বজ্রপাতের হার হ্রাস করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও বিভিন্ন পদক্ষেপে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে।
সরকারি উদ্যোগ : মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণার পর এ ঘটনায় মৃত্যু ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অগ্রাধিকারে আছে ১০ লাখ তালগাছ রোপণ। পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ির ছাদে বজ নিরাপত্তা টাওয়ার এবং হাওর এলাকায় একতলা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি