কক্সবাজার প্রতিনিধি:
কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকায় আবারও সক্রিয় হয়ে উঠার চেষ্টা করছে সাগর পথে মানবপাচারকারীরা। মিয়ানমার থেকে নতুন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নানা প্রলোভন দেখাতে শুরু করেছে তালিকাভুক্ত ৩০০ পাচারকারী ও তাদের সহযোগীরা। ২০১৫ সালের অভিযানে গ্রেফতার হওয়া ও গা ডাকা দেয়া উখিয়া-টেকনাফ ও রামু উপকূলীয় এলাকার গডফাদাররাও আবারও প্রকাশ্যে এসেছে।
সম্প্রতি সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে দালালসহ আটক হয়েছে ৫ রোহিঙ্গা। তবে, এখন পর্যন্ত নতুন করে বাংলাদেশ সীমানা দিয়ে সাগর পথে মানবপাচার হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। কক্সবাজার উপকূল ছাড়াও টেকনাফ, উখিয়া, রামু, সদর, কক্সবাজার শহর ও মহেশখালির ৬০ পয়েন্ট দিয়ে মানবপাচার হয়ে আসছিলো। এর মধ্যে উখিয়া উপজেলার রেজু মোহনা, সোনারপাড়া, মনখালী, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপের ঘোলাপাড়া, পশ্চিমপাড়া, দক্ষিণপাড়া, সাবরাং ইউনিয়নের কচুবুনিয়া, কাটাবুনিয়া, খুরেরমুখ, মুন্ডারডেইল, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মহেশখালিয়া পাড়া, লম্বরী, হাবিরছড়া, বাহারছড়া ইউনিয়নের বড় ডেইল ও শামলাপুর, রামু উপজেলার হিমছড়ি, পেচারদ্বীপ, কক্সবাজার পৌর সভার সমিতি পাড়া, নাজিরার টেক, মাঝির ঘাট ও চৌফলন্ডি ঘাট এলাকা দিয়ে সবচেয়ে বেশি মানবপাচার হয়েছে।
২০১২ সালে মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গা শুরুর পর রোহিঙ্গারাই সাগর পথে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেয়া শুরু করেছিলো। রোহিঙ্গাদের দেখানো পথে ২০১৩-২০১৫ সাল পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে সাগর পথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড পাড়ি দিয়েছিলো। দালালের ক্ষপ্পরে পড়ে সাগর পথে পাচারের সময় ট্রলার ডুবিতে অনেক বাংলাদেশি মারা যায়। এছাড়া থাইল্যান্ডের উপকূলীয় এলাকায় দালালের আস্তানায় করুন মৃত্যু হয়েছিলো পাচার হওয়া অনেক হতভাগ্য মানুষের।
ওই সময় সাগর পথে মানবপাচার রোধে হার্ড লাইনে গিয়েছিলো সরকার। কক্সবাজারের ২৫০ জন মানবপাচারকারীর তালিকা করে অভিযানে নেমেছিলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর গুলিতে মারা গিয়েছিলো ৫ জন গডফাদার। অাটক হয়েছিলো শতাধিক পাচারকারী। আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলো গডফাদাররা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সফল অভিযানে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো অবৈধভাবে সাগর পথে মানবপাচার।
মিয়ানমারের নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঘিরে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে সাগর পথে পাচারকারীরা। কিছুদিন আগে টেকনাফের বাহারছড়ার বড়ডেইল গ্রামের একটি বাড়ি থেকে দুই রোহিঙ্গাসহ পাঁচজনকে পুলিশ আটক করে। সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য তাদের সেখানে জড়ো করা হয়েছিল বলে আটকরা পুলিশকে জানিয়েছে। রাতে মাছ ধরার ট্রলারে করে তাদের মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা ছিল। এর আগেই ওই পাঁচজনসহ ছয়জনকে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আটক করে পুলিশ।
এদিকে আবারও নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠছে তালিকাভুক্ত মানবপাচারের শীর্ষ গডফাদার উখিয়ার নুরুল কবির ও তার স্ত্রী রেজিয়া আক্তার, প্রকাশ, বেবি ম্যাডাম, রুস্তম আলী, ছেপটখালীর ফয়েজ, আবুল কালাম, লম্বরীপাড়ার লাল বেলাল, সোনাইছড়ির লালু মাঝি, আলী আকবর, জালিয়াপালং ইউনিয়নের জুম্মাপাড়া গ্রামের ছানা উল্লাহ, সোনাইছড়ি গ্রামের বেলাল মেম্বার, মীর আহমদ, সিকদার বিলের আবুল কালাম, দক্ষিণ সোনারপাড়া গ্রামের ছৈয়দ আলম, মুজিবুল হক, মোসলেম উদ্দিন, জালাল, ছৈয়দ, টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নুর হোছন, মো. নাগু, টেকনাফের নাজিরপাড়ার কামাল, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের দিল মোহাম্মদ, মো. ফারুক, জোবাইর হোসেন, টেকনাফের শাপলাপুর পুরান পাড়ার আশিক উল্যাহ, শহীদুল্লাহ, শফি উল্লাহ, টেকনাফের মিস্ত্রিপাড়ার হাতকাটা ছলিম ও একই এলাকার এনায়েত উল্লাহ।
শাহ পরীরদ্বীপ দাঙ্গার পাড়ার মো. হাসিম, দেলোয়ার হোসেন, সাহাব মিয়া, নুর হাকিম মাঝি, আমিন উল্লাহ ভুলু, নজির আহমদ, টেকনাফ শীল বনিয়া পাড়ার হেফজুর রহমান প্রকাশ হেফজ মাঝি, মোহাম্মদ মাঝি, পৌর সভার নাইপুরান পল্লান পাড়ার নুর হাফেজ। সাবরাং ইউনিয়নের মুন্ডার ডেইলের শাকের, নজির মেম্বারের ছেলে আবদুল মাজেদ, আবদু শুকুর, অলী আহমদ, কোয়াইনছড়ি পাড়ার বশির আহমদ, কচু বনিয়া এলাকার আবদুল করিম, আবদুল্লাহ, নজির আহমদ, মো. ইসলাম (বাঘু), আবুল কালাম, রশিদ উল্লাহ ডাইলা, ইমাম হোছন, মোহাম্মদ আমিন, জাহেদ হোসেন, শওকত ফারুক, ফরিদ আহমদ, কাটা বনিয়া এলাকার- আবদুল্লাহ, জাফর আলম, আবদুর রহিম, ছলামত উল্লাহ, আবুল কাশেম ও তাদের সহযোগীরা।
সাগর মানবপাচারে সহযোগিতাকারী একাধিক পুলিশ সদস্যের নাম উঠে এসেছিলো বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। সেই সময় বদলি হলেও ঐ পুলিশ সদস্যরা এখন আবার ঘুরেফিরে মানবপাচার প্রবণ এলাকায় কর্মরত। তাই আবারও সাগর পথে মানবপাচারের আশংকা করছেন সাগর মানবপাচার প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আবুল কাশেম। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল জানান, মানবপাচাররোধে পুলিশ এখনো হার্ড লাইনে আছে। নতুন করে কক্সবাজার উপকূল ব্যবহার করে কোনো মানবপাচার হয়নি। তবে রোহিঙ্গারা সাগর পথে মালেয়েশিয়া-থাইল্যান্ড চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের কয়েকটি প্রচেষ্টা থামিয়ে দেয়া হয়েছে।
উখিয়া- টেকনাফের উপকূলীয় এলাকা বিশেষ করে উখিয়ার জালিয়া পালং, টেকনাফের বাহারছড়া, সাবরাং ও শাহ পরীরদ্বীপে পুলিশের পক্ষে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি নতুন করে সাগর পথে মানবপাচার শুরু করতে চায় তাদের ভয়াবহ পরিণতি হবে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি