নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালের ১১ নভেম্বর ব্যবসার অনুমোদন পায় মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে কোম্পানিটি। এরপর ২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। গ্রামীণফোনের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৮ সালে কোম্পানিটির কর পরবর্তী একক মুনাফা হয়েছিল ২৯৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। পরের বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে কোম্পানিটির একক কর পরবর্তী মুনাফা দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৯৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এভাবে ২০১০ সালে কোম্পানিটির কর পরবর্তী সমন্বিত মুনাফা ১ হাজার ৭০ কোটি ৫০ লাখ, ২০১১ সালে ১ হাজার ৮৮৯ কোটি ১০ লাখ এবং ২০১২ সালে আগের বছরের তুলনায় সামান্য কমে ১ হাজার ৭৫০ কোটি ৫ লাখ টাকায় স্থিতি পায়। এরপর ২০১৩ সালে কোম্পানিটির মুনাফা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা কমে ১ হাজার ৪৭০ কোটি ১৫ লাখ টাকায় স্থিতি পায়। যদিও ২০১৪ সালে কোম্পানিটির মুনাফা ১ হাজার ৯৮০ কোটি ৩২ লাখ টাকা অতিক্রম করে। ২০১৫ সালেও কোম্পানিটি মুনাফা করে ১ হাজার ৯৭০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
২০১৬ সালে ২ হাজার কোটি টাকার মুনাফা অতিক্রম করে গ্রামীণফোন। এ বছর কোম্পানিটির কর পরবর্তী মুনাফা হয় ২ হাজার ২৫২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। আর ২০১৭ সালে মুনাফার অতীত সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে কোম্পানিটি। এ সময় ২ হাজার ৭৪২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার মুনাফা করেছে গ্রামীণফোন। এসব তথ্য থেকে স্পষ্ট, বছরের পর বছর গ্রামীণফোন শুধু মুনাফাই করেছে। আয়ে তাদের অবস্থান বলা চলে আকাশচুম্বি। কিন্তু, বিপরীতে তাদের সেবার মান নিয়ে যত দিন গড়িয়েছে, ততই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
গ্রামীণফোনের গ্রাহকেরা বলছেন, যত দিন যাচ্ছে, কোম্পানিটি তত বেশি কমার্শিয়াল হয়ে যাচ্ছে। সেবার মান বাড়ানোর দিকে তাদের কোনো নজর নেই। গ্রাহক বাড়ছে, আয় বাড়ছে কিন্তু তারা সেবার মান মোটেও বাড়াচ্ছে না। গ্রামীণফোন দিন দিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো আচরণ করছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ মোবাইল ফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী অনিক মেহমুদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সেই ২০০৬ সাল থেকে গ্রামীণফোন ব্যবহার করছি। কিন্তু, ১২ বছর পরে এসেও কলড্রপের যন্ত্রণায় অতিষ্ট। সবচেয়ে বিরক্তিকর দিনে অসংখ্যবার অপ্রয়োজনীয় এসএমএস।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় নানা লোভনীয় অফার দিয়ে মেসেজ দেয় গ্রামীণফোন। কিন্তু, বাস্তবে তেমন কোনো অফার পাওয়া যায় না। একটা প্রথমসারির মোবাইল অপারেটরের কাছে এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত। দিন যত যাচ্ছে, তাদের সেবার মান তত খারাপ হচ্ছে।’
শরিফ উদ্দিন বাপ্পি নামে গ্রামীণফোনের এক গ্রাহক বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি গ্রাহক গ্রামীণফোনের। তাদের আয়ও আকাশচুম্বি। কিন্তু, প্রত্যাশিত সেবাটা পাচ্ছি না। এখনও অন্য অপারেটরদের চেয়ে তাদের কল রেট, ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য বেশি।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘গ্রাহকের কোনো অভিযোগ গ্রামীণফোন এখন আর আমলে নেয় না। কল সেন্টারে কল করেও উপকার হয় না। বিপরীতে টাকা কেটে নেয়। বিটিআরসিকে এদিকে বিশেষ নজর দেয়া উচিত।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১ জুন থেকে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাদের কাছে মোবাইল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ৭৫৮টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধেই তিন শতাধিকের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- প্যাকেজ প্রতারণা, পর্যাপ্ত সেবা না পাওয়া, কলড্রপ, সময়-অসময়ে এসএমএস, ইমারজেন্সি ব্যালেন্সের নামে অতিরিক্ত টাকা কাটার অভিযোগ, ফোনের ইন্টারনেট সংযোগ শেষ হয়ে গেলে কোনো সংকেত বা এসএমএস ছাড়া ব্যালেন্স থেকে টাকা কাটার অভিযোগ ইত্যাদি।
খোদ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনেই (বিটিআরসি) যেসব অভিযোগ জমা পড়ে, তার অধিকাংশই গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ বিটিআরসি একটা হিসাব প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিটিআরসির কাছে অভিযোগ পড়েছে ৩ হাজার ৫২২টি। এর মধ্যে শুধু গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ১ হাজার ৯৭৩টি।
বিটিআরসি থেকে প্রাপ্ত হিসাবে দেখা যায়, গ্রামীণফোন ছাড়া বাংলালিংকের বিরুদ্ধে ৬১২টি, রবির বিরুদ্ধে ৬০৪টি, এয়ারটেলের বিরুদ্ধে ২২১টি, টেলিটকের বিরুদ্ধে ১০৪টি ও সিটিসেলের বিরুদ্ধে ৮টি অভিযোগ করেছেন গ্রাহকেরা। এসব অভিযোগের বিষয়ে বিটিআরসি থেকে গ্রামীণফোনের কাছে জানতে চাওয়া হলেও তারা কোনো সুরাহা করেনি। এমনকি বিটিআরসিকেও কিছু জানানো প্রয়োজন মনে করেনি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে গ্রাহকদের অভিযোগ দিনের পর দিন অবহেলিতই রয়ে গেছে।
গ্রাহকদের এমন অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নতুন কিছু না। বহু আগে থেকেই আসছে। কিন্তু, তারা এসব নিয়ে নির্বিকার। প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র লক্ষ্য গ্রাহক বাড়িয়ে মুনাফা কামানো। কে কি সেবা পেল, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আসলে আমাদের দেশে কোনো জবাবদিহিতা নেই বলেই কোম্পানিগুলো একচেটিয়া মুনাফা করছে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধপ্রবণ মানসিকতায় মুনাফা করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। গ্রামীণফোন এখন ব্যবসায়িক চিন্তার বাইরে কিছু কল্পনাও করতে পারে না।’
মহিউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনেরও (বিটিআরসি) কড়া সমালোচনা করেন। বলেন, ‘দেশে ইন্টারনেটের গতি ৫ এমবিপিএস বলা হলেও মোবাইল ইন্টারনেটে তা অনেক কম। সর্বোচ্চ ২ থেকে ৩ এমবিপিএস হতে পারে। বিটিআরসির কাছে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি মাপার যন্ত্র কিন্তু নেই। কলড্রপ কত হয় তাও তারা জানে না। বিটিআরসি একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।’ এ বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ‘আমরা অপারেটরগুলোকে নির্দেশ দিয়েছি- অবশ্যই গ্রাহকদের সেবাটা আগে নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ডাক টেলিযোযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘সব ধরনের অভিযোগের বিষয়ে বিটিআরসিকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে আমার নিজেরও অভিযোগ রয়েছে। কলড্রপ নিয়ে আমি বিটিআরসিকে নিজে অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু, এখনঅব্দি কোনো ব্যবস্থা নিতে আমি দেখিনি।’ এসব অভিযোগের বিষয়ে গ্রামীণফোনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে ফোন করে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে ই-মেইলে বক্তব্য চাওয়া হলেও তারা সাড়া দেননি।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি