২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৭:২৫

ভয়াবহ কিশোর গ্যাংয়ের কবলে কিশোরগঞ্জ

‘কিশোর গ্যাং’এর সর্বনাশা কালচারে ডুবেছে কিশোরগঞ্জও। দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে এদের লাগামহীন দৌরাত্ম্য।

শহরের আবাসিক এলাকা, অলিগলি, স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার, মাকের্ট-বিপণীতে যে কোন সময় শুরু হয়ে যায় এদের ত্রাসের রাজত্ব।

২০১৮ সালের শেষের দিকে সংঘবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে আসতে দেখা যায় এদের। আচমকা কেঁপে ওঠে নিরবে নিভৃতে থাকা কিশোরগঞ্জ শহর। মুখোশধারী স্বশস্ত্র কিশোর সন্ত্রাসীরা হকিস্টিক, চাপাতি, রামদা, ছুরি-লাঠি জাতীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। রাস্তার পাশের বাসাবাড়ি-দোকানপাটে ভাঙচুরের পাশাপাশি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে পথচারী ও সাধারণ মানুষদের। এরপর উধাও হয়ে যায়।

ছোট-খাটো যে কোন ইস্যুতে এসব কিশোররা একত্রিত হয়ে হামলা চালায়। কিশোরদের বহর মহড়া দিয়ে মুখে কালো কাপড় বেঁধে আবাসিক এলাকাগুলোতে সিনেমা কায়দায় আতঙ্ক তৈরি করে। দেখলে মনে হবে কোন মারদাঙ্গা ছবির স্যুটিং। এসব কিশোরদের আচমকা হামলার শিকার হয়েছেন অনেক নতুন আগুন্তকও। তবুও এসকল ‘কিশোর গ্যাং’ এর সদস্যরা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

এসব কিশোর দল গত এক বছরে তিনটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।

শহরের বড় বাজার-তেড়িপট্টি এলাকায় কলেজ ছাত্র রাজা হত্যাকাণ্ডের হোতা এই কিশোর গ্যাং। শহরের ঈশাখাঁ রোডে যুবলীগ নেতা ইউসুফ মনিকেও নৃশংসভাবে খুন করে তারা। এসময় ওই এলাকার আশপাশের অনেক দোকানপাটের শাটারে ও রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে হকিস্টিক দিয়ে ভেঙ্গে ত্রাস সৃষ্টি করে। এছাড়া পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এর প্রবেশ পথে তরুণ ব্যবসায়ী সাগরকেও খুন হয় উচ্ছন্নে যাওয়া এই কিশোরদের হাতে।

‘সাজ্জাদ বাহিনী’নামের একটি কিশোর গ্যাং দল সম্প্রতি বত্রিশ এলাকায় রাতে শারদীয় দুর্গাপূজার আরতির সময় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা শুরু করে। আর তার প্রতিবাদ করে শুভ সরকার, প্রসেনজিৎ ঘোষ এবং তনয় বর্মণ বিকাশ নামের তিন কিশোর। এ নিয়ে সাজ্জাদ বাহিনীর সাথে তাদের বাগবিতণ্ডা হয়।

এর তিনদিন পর রাতে সাজ্জাদ বাহিনী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে রীতিমত ‘অপারেশন প্ল্যান’ হাতে নিয়ে অপারেশনে বের হয়। একটি সাদা কাগজে লাল কালিতে মার্ক করা ছিল- ‘মিশন শেষ করেই ফিরবো ইনশাল্লাহ।’ কতজন কোন কোন রাস্তা দিয়ে অপারেশনে যাবে, কার কার বাসায় হামলা চালাবে- কাগজে রোডম্যাপ তৈরি করা হয়। ঠিক সময়ে প্ল্যান মোতাবেক হামলা চালায় কিশোর অপরাধীরা। সাজ্জাদ ও তার দলের সদস্যরা শুভ সরকার, প্রসেনজিৎ ঘোষ ও তনয় বর্মণ বিকাশকে দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। হামলার খবর পেয়ে র‌্যাবের একটি দল অভিযান চালিয়ে শহরের বত্রিশ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন তাতিপাড়া এলাকা থেকে সাজ্জাদসহ তার দলের ১১ সদস্যকে আটক করে। পরে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আটকদের কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়।

আটককৃতরা হচ্ছে সদর উপজেলার কালিয়াকান্দা গ্রামের আব্দুল আউয়ালের ছেলে সাজ্জাদ গ্রুপের প্রধান সাজ্জাদ, কটিয়াদীর গচিহাটা এলাকার মো. মোজাম্মেল হকের ছেলে আব্দুলাহ আল নোমান, একই উপজেলার করগাঁও গ্রামের মো. আইয়ুব হাজীর ছেলে মো. জুয়েল, জেলা শহরের উকিলপাড়া এলাকার মো. বুলবুল আহম্মেদের ছেলে মো. সানি আহাম্মেদ, স্টেশন রোড এলাকার ফজলুল মতিন সিদ্দিকির ছেলে ফজলুল করিম আকাশ, খরমপট্টি এলাকার সমির বৈষ্ণবের ছেলে সৌমিত্র বৈষ্ণব, বত্রিশ এলাকার মো. সুলতানের ছেলে ফজলে রাব্বি বাধন, একই এলাকার মুনসুর আলমের ছেলে মো. আনোয়ারুল ইসলাম, জালাল উদ্দিনের ছেলে মো. ইয়াছিন ইসলাম, রাখাল দত্তের ছেলে হৃদয় দত্ত ও মোফাজ্জল ইসলামের ছেলে মো. আদনান ইসলাম। দেখা যায় এরা সবাই বয়সে কিশোর।

কিশোরগঞ্জে ‘কিশোর গ্যাং’ বাহিনীর তাণ্ডব ও দৌরাত্ম্য স্বয়ং রাষ্ট্রপতিরও জানা। অতি সম্প্রতি (৯-১৫ অক্টোবর) ৭দিনের সফরে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জের একটি অনুষ্ঠানে শহরে ‘কিশোর গ্যাং’ এর উৎপাত নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘শিগগিরই এসব ‘কিশোর গ্যাং’ বাহিনীর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা না নিলে ও তাদের আটকানো না গেলে ভবিষ্যতে এরা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।’

অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের আড়াল থেকে কেউ মদদ দিচ্ছে বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের মানুষজন। তারা মনে করেন, এখনই যদি ‘কিশোর গ্যাং’ এর লাগাম টেনে ধরা না যায় তাহলে আগামিতে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে এরা।

সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক সাইফুল হক মোল্লা দুলু বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে কিশোর গ্যাং-এর অপতৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে শহরের স্কুল-কলেজ, লেকপাড় ও অলিগলিতে তারা আড্ডা দেয়। সাধারণত এদেরকে দেখে বোঝার উপায় নেই তারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু কিছু বলতে গেলেই তারা চাপাতি, রামদা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বের হয়ে হামলা চালায়। যার ফলে শহরের সভ্য ও সামাজিক মানুষরা আজ তাদের কাছে জিম্মি।’

সামাজিক আন্দোলন এর সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অশোক ঘোষ বলেন, ‘কয়েকবছর ধরে কিশোরগঞ্জে ‘কিশোর গ্যাং’ এর তৎপরতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের কারণে কয়েকজন কিশোরও খুন হয়েছে। প্রকাশ্যে তারা মারাত্মক অস্ত্রাদি নিয়ে মহড়া দেয়, শক্তির দাপট দেখায়, সাধারণ মানুষকে অত্যাচার-নির্যাতন এবং সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। প্রায় দুই বছর পূর্বে শহরের নগুয়া এলাকায় সন্ধ্যার পর ‘কিশোর গ্যাং’ এর একটি দল মুখে কালো কাপড় বেঁধে ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। রাস্তায় যাকে পেয়েছিল তাকেই কুপিয়ে জখম করেছিল। এ সময় তারা ১৮জনকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেছিল। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে রাস্তার পথচারী নারী পর্যন্ত তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।’

কিশোরগঞ্জ মহিলা পরিষদ এর সভাপতি অ্যাডভোকেট মায়া ভৌমিক ‘কিশোর গ্যাং’ সম্পর্কে বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই এদের উৎপাত ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, অশ্লীল কথাবার্তা বলা এমনকি তাদের কাছ থেকে মোবাইল, ব্যাগ ও চেইন ছিনতাই করছে তারা। যার ফলে এসকল ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছে। স্কুল-কলেজ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ড্রেস পরিহিত ছেলেদের গ্রুপ করে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়।’

কিশোরগঞ্জ শহরের বিভিন্ন কর্ণারে কিশোর অপরাধীদের এ রকম অন্তত ৩০/৩৫টি গ্যাং আছে। প্রতিটি গ্যাং এ ৫০/৬০ জন সদস্য রয়েছে। সদস্যদের অধিকাংশই কিশোরগঞ্জ শহরের বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র ও  খসে পড়া শিক্ষার্থী, বেকার ও শ্রমিক শ্রেণির কিশোরও। এদের মধ্যে কোনো কোনো গ্যাং স্বাধীনভাবে চলে। আবার কোনো কোনো গ্যাং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বড় ভাইদের ছত্রছায়া ও আধিপত্য বিস্তারের মহড়ায় সশস্ত্র অংশ নিয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে পুলিশ অভিযান চালিয়ে এসব কিশোর গ্যাং এর সদস্যদের আটক করলেও অধিকাংশ লিডার ও সদস্য এখনও অধরা রয়ে গেছে।

কিশোর গ্যাং-এর দৌরাত্ম্য বন্ধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের ব্যাপারে পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, ‘২০১৮ সালের শেষের এদের একটা প্রবণতা আমাদের চোখে পড়েছিল। তারপর আমরা একটা স্পেশাল টিম গঠন করি, যেখানে লোকাল থানা এবং ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) সেটা পরিচালনা করছে। তবে এ ব্যাপারে পুলিশ সবসময় সজাগ এবং কার্যক্রমও চলমান। যার ফলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। সন্ধ্যার পর যে সকল ছেলেরা ঘোরাঘুরি করে, কোচিং বা প্রাইভেটের কথা বলে বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা দেয় তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অভিভাবকের হাতে তুলে দিয়েছি এবং আমরা তা ফলপ্রসুও হয়েছে। আশা করছি ধীরে ধীরে এর প্রবণতা কমতে শুরু করবে।’

প্রকাশ :অক্টোবর ২৯, ২০১৯ ১২:১৭ অপরাহ্ণ