জেলা সংবাদদাতা:
ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসের হত্যাকাণ্ডস্থলে এবার আওয়ামী লীগ নেতার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে সশস্ত্র হামলা ও তাণ্ডব চালিয়েছে সশস্ত্র শিবির ক্যাডাররা। অনন্ত হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত, দীর্ঘ প্রায় তিন বছরে সেটা জানা না গেলেও আওয়ামী লীগ নেতার প্রতিষ্ঠানে হামলায় শিবির জড়িত। এ নিয়ে শহরজুড়ে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে।
গত শুক্রবার নূরানী আবাসিক এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে সশস্ত্র এই হামলার ঘটনা ঘটলেও কেউই ভয়ে মুখ খুলতে চাইছে না। স্থানীয় পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও দোষীদের পরিচয় জানাতে চাইছে না। এমনকি আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান এবং বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীও কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নগর জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের প্রার্থী হওয়ার পর থেকে অশান্ত হয়ে উঠছে সিলেট নগরী। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের কর্মীদের দূরত্ব বাড়ছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও স্বস্তি পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে নূরানী আবাসিক এলাকাসহ সুবিদবাজার ও হাউজিং এস্টেট এলাকায় জামায়াত কর্মীদের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
কয়েক দিন নগরীর বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, সিটি নির্বাচন সামনে রেখে হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে উঠেছে ছাত্রশিবিরের তৎপরতা। তারা নগরজুড়ে এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। তাদের বেশিরভাগই বহিরাগত। জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে সিলেটে এসে নির্বাচনী প্রচারণা কার্যক্রম চালাচ্ছে। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা জামায়াত-শিবিরের স্থানীয় ক্যাডাররাও প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছে।
মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির ফখরুল ইসলাম অবশ্য সবকিছু অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর পক্ষেও বহিরাগতরা প্রচার চালাচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে নগর জামায়াতের আমিরের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন তার আত্মীয়স্বজনরা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বহিরাগত থাকতেই পারেন। তবে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করে মিছিলের প্রসঙ্গে স্থানীয় জামায়াত নেতারা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। নগরীর বিভিন্ন স্থানে মিছিলের মাধ্যমে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও এর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসনকে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
অনেকের মতে, ভোটের মাঠে সুবিধা করতে না পারলেও ২০ দলীয় জোটের শরিক বিএনপির সঙ্গে দরকষাকষির সুবিধার্থে নির্বাচনী প্রচারের আড়ালে মূলত সংগঠনকে চাঙ্গা করার মিশনে নেমেছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত। ফলে ভোটারদের চেয়ে নগরীর বিভিন্ন মেসে বসবাস করে আসা বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষার্থীদের কৌশলে দলে ভেড়ানোর মিশনে নেমেছে শিবিরের বহিরাগত ক্যাডাররা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও অধিকাংশ মেসে এক সময় শিবিরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার ফলে মাঝে এদের দৌরাত্ম্য কমলেও সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা ওই এলাকায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। নগরীর আখালিয়া, সুবিদবাজার, শিবগঞ্জ, দরগা মহল্লাসহ পুরাতন এলাকাগুলোকে টার্গেট করে মাঠে নেমেছে জামায়াত-শিবির।
এ অবস্থায় দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকলেও এবারে বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে স্থানীয় জামায়াত। এ নিয়ে দুই দলের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে টানাপড়েন সৃষ্টি হলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক ও দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন এটাকে ‘নাটক’ বলছেন। আবার আওয়ামী লীগ নেতার প্রতিষ্ঠানে সশস্ত্র হামলা ও তাণ্ডবের পেছনে ‘পাতানো খেলা’ দেখছে বিএনপি। সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলছে। ফলে অসংখ্য মামলা মাথায় নিয়েও জামায়াতের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে প্রচারে নামতে পারছে। এর জবাবে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ সমকালকে বলেন, নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে বলেই আবোলতাবোল বকছে বিএনপি।
সিলেটের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক আবদুল আজিজের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন সব কিছু দেখবে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকে স্রদ্ব্যাটেজি হিসেবে নিয়েছে জামায়াত। তারা অনেক দিন ধরেই চাপে আছে। তাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা সামনে আসতে পারবে বলে মনে করছে। তবে এসব ঘটনায় মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে।
জামায়াত-শিবিরের অপতৎপরতার ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সিপিবি-বাসদ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আবু জাফর। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবিদাররা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য জামায়াত-শিবিরকে মাঠে নামার সুযোগ করে দিয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা বিক্ষুব্ধ। মানুষ কোনোভাবেই এটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করছে না। জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা নগরজুড়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সহিংসতার মামলার অনেক আসামি এই সুযোগে প্রকাশ্যে জামায়াতের মেয়র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নেমেছে।
জামায়াত-শিবিরের কর্মকাণ্ডকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ উল্লেখ করে সিলেট জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান আহমদ বলেন, এসব ঘটনা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য হুমকি। সবাই সুন্দর নির্বাচনের প্রত্যাশা করছে।
জামায়াতের আদর্শিক অবস্থান গণতান্ত্রিক নয় জানিয়ে জেলা সিপিবির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট বেদানন্দ ভট্টাচার্য্য বলেন, জামায়াত একটি অগণতান্ত্রিক দল। তাদের তৎপরতা জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। এসব দেখার দায়িত্ব সরকারের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা করতে ব্যর্থ হলে সরকারকেও মূল্য দিতে হবে।
নূরানী আবাসিক এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতার মালিকানাধীন মৌরশী রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির মালিক আবদুল হান্নান জানান, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ও নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আফতাব হোসেন খানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক তিনি। এ ছাড়া সিলেট নগর আওয়ামী লীগেরও নেতা।
মৌরশী রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষের ধারণ করা ৫৪ সেকেন্ডের ভিডিও চিত্রে ৭ নং ওয়ার্ড শিবিরের সভাপতি দিপুকে এই হামলায় নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। পাঁচটি মোটরসাইকেলে করে ১০ থেকে ১২ জন শিবির ক্যাডার ওই হামলায় অংশ নেয়। এদের প্রত্যেকের হাতেই রামদা ও লোহার পাইপ ছিল।
এ ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর আফতাব হোসেন অভিযোগ করেন, প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থী জামায়াতের সাঈদ মো. আবদুল্লাহর কর্মী শিবির ক্যাডাররা এ হামলা চালিয়েছে।
এসব বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া জানান, সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন-সংক্রান্ত আইনের লঙ্ঘন হলে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।