১৯শে মে, ২০২৪ ইং | ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ২:১২

সাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহর আশংকাই বেশি

ধর্ম ডেস্ক :

আমাদের দেশে ইদানীং বাংলা উচ্চারণে পবিত্র কোরআন শরিফ ছাপা হচ্ছে, অনেকে তা কিনে পড়ছেনও। যাঁরা এ কাজটি করছেন আর যাঁরা তা কিনে পড়ছেন তাঁরা হয়তো ভাবছেন, এতে তাদের সাওয়াব হবে। আমি মনে করি, বাংলা উচ্চারণে ছাপা কোরআন যে বা যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের সাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহও হতে পারে। তাই সম্মানিত পাঠকদের উদ্দেশে বিনীত আরজ, আপনি হয়তো সাওয়াব মনে করে পড়ছেন; কিন্তু একটি কথা খেয়াল রাখবেন, বাংলা উচ্চারণে আরবি হরফের সঠিক উচ্চারণ হয় না।

মনে রাখবেন, আরবি ২৯টি হরফ উচ্চারণের জন্য ২৯টি স্থান আছে। সে স্থানগুলো ঠোঁট থেকে শুরু করে কণ্ঠনালির ভেতর পর্যন্ত। এর কয়েকটি স্তর আছে। এসব স্তর হলো আরবি হরফগুলোর উচ্চারণের স্থান, যাকে মাখরাজ বলা হয়।

আপনি হয়তো বলবেন, আমি তো কোরআনই পড়ছি। তাতে না হয় একটু টানটুনের বেশকম হয়, তাতে আর সমস্যা কী? হ্যাঁ, সমস্যা আছে। তা আপনি যদি এ ভাষার গভীরে পৌঁছতে পারেন, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন। তবুও আপনার জন্য বিষয়টা একটু খুলেই বলি। আরবি ‘কাফ’ হরফের উচ্চারণ দুই জায়গা থেকে হয়। ‘হা’ উচ্চারণও দুইভাবে হয়। প্রতিটি হরফের জন্যই আলাদা মাখরাজ বা উচ্চারণের বিশেষ স্থান আছে। এর সামান্য বেশকম হলে কোরআনের শব্দের অর্থের বিরাট ব্যবধান হয়ে যাবে। তখন সাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহও হয়ে যেতে পারে। এমনকি আল্লাহও বেজার হয়ে যেতে পারেন। যেমন আমরা পড়ি আউজু- এখানে ‘আলিফ’, ‘আইন’, ‘ওয়াও’ ও ‘জাল’- এই চারটি অক্ষর আছে। এখানে আইন অক্ষরটি সঠিক স্থান থেকে উচ্চারিত না হলে তা হবে হামজার উচ্চারণে। ফলে হামজা অক্ষর দিয়ে উচ্চারিত হয়ে যে ‘আউজু’ শব্দ গঠিত হবে তার অর্থ হবে, আমি কষ্ট চাই। অথচ আউজু বিল্লাহি…এর সঠিক উচ্চারিত শব্দটির অর্থ হলো- আমি আশ্রয় প্রার্থনা করি আল্লাহর কাছে। তাহলে ‘আউজু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম’-এর অর্থ হলো- আমি আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাই। কিন্তু ‘আউজু’ উচ্চারণ ভুল করে পড়লে এর অর্থ হবে আমি আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে কষ্ট চাই। অন্যদিকে ‘আল-হামদু’ শব্দটির মধ্যে যে ‘হা’ আছে, সেটি ‘জিম’ হরফের পরের ‘হা’ হরফ। এর অর্থ হবে ‘সকল প্রশংসা’। তাহলে ‘আলহামদু লিল্লাহি’র অর্থ হবে সকল প্রশংসাই আল্লাহর জন্য। কিন্তু আরবিতে আরো একটি ‘হা’ হরফ আছে, সেটি হামজার পরের ‘হা’। এখন এ ‘হা’ হরফ দিয়ে যদি ‘হামদু’ শব্দ উচ্চারণ করে পড়েন, তাহলে তার অর্থ হবে মৃত্যু ও আগুনের তাপ। তাই এ ‘হা’ হরফ দিয়ে যদি কেউ ‘আলহামদু’ পড়ে, তাহলে কী সাংঘাতিক কদর্থ হবে ভেবে দেখেছেন? (নাউজু বিল্লাহ!)

আরেকটি শব্দ দেখুন, যেমন ‘আলিম’। যার প্রথমে ‘আইন’ হরফ দিয়ে উচ্চারিত, এর অর্থ হলো অতিশয় জ্ঞানী। তাই ‘আল্লাহু আলীমুন’-এর অর্থ হবে আল্লাহ অতিশয় জ্ঞানী। কিন্তু একই উচ্চারণে (আলিম) আরেকটি শব্দ রয়েছে, যার প্রথমে হামজা হরফে উচ্চারিত হয়। এর অর্থ হলো কঠিন পীড়াদায়ক। যেমন ‘আজাবুন আলিম’- অর্থাৎ কঠিন পীড়াদায়ক শাস্তি।

কাজেই এমন কিছু শব্দ উচ্চারণ করা, যা আল্লাহ বলেননি, তা যদি আমরা উচ্চারণ করি সাওয়াবের আশায়, তবে কি সাওয়াব হবে? মোটেই না। কেননা পবিত্র কোরআনের ভাষা কী, সে ব্যাপারে আল্লাহপাক সুস্পষ্ট কয়েকটি আয়াত নাজিল করেন। যেমন সুরা নাহলের ১০৩ নম্বর আয়াত, অর্থাৎ ‘… এটি সুস্পষ্ট আরবি ভাষার কোরআন। ‘ সুরা শোয়ারায় ১৯৫ নম্বর আয়াতেও একই কথা বলা হয়েছে। সুরা ইউসুফের ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘নিঃসন্দেহে আমি (আল্লাহ) একে আরবি কোরআন নাজিল করেছি, যেন তোমরা তা অনুধাবন করতে পারো। ‘ এখানে আয়াতে ‘ক্বোরআনান ‘আরাবিয়া’ বলা হয়েছে, যার অর্থ হবে ‘আরবিতে পঠিত’ করে অবতীর্ণ করেছি। আবার সুরা আহকাফের ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘লিছানান ‘আরাবিয়া’- অর্থাৎ আরবি ভাষায়, সুরা শুরায় ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আওহ্বাইনা ইলাইকা ক্বুরআনান আরবিয়া’- অর্থাৎ ‘তোমার কাছে এ ক্বুরআন অহি করেছি আরবিতে। ‘ সুরা রা’দের ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘(হে নবী) এভাবেই এ বিধান (তোমার ওপর) আরবি ভাষায় নাজিল করেছি, (যেন তুমি সহজেই বুঝতে পারো); তোমার কাছে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) যে জ্ঞান এসেছে, তা সত্ত্বেও যদি তুমি তাদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহর সামনে তোমার কোনোই সাহায্যকারী থাকবে না। না থাকবে তোমাকে বাঁচানোর মতো কেউ!’

প্রিয় পাঠক, বুঝতেই পারছেন আল্লাহপাক পবিত্র কোরআন আরবি ভাষায়ই নাজিল করেছেন। এ ভাষা থেকেই তা বুঝতে হবে এবং পড়তে হবে। কোরআন শুদ্ধ করে না পড়লে নামাজও হবে না। এ ছাড়া সামান্য হেরফের উচ্চারণও আল্লাহপাক ছাড় দেননি। একবার ‘রায়েনা’ শব্দ বলে কিছু লোক রাসুল (সা.)-কে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সম্বোধন করলে আল্লাহপাক তাতে সংশোধনী দিয়ে বলেছেন, তোমরা রায়েনা শব্দ বলো না; বরং উনজুরনা বলো। কেননা শব্দটি শুদ্ধ করে সাধারণ মানুষ উচ্চারণ করতে পারত না বলেই আল্লাহপাক এই সংশোধনী দিয়েছিলেন।

আলেমদের অভিমত আরবি ভাষার সঠিক উচ্চারণেই কোরআন পড়তে হবে। এর ব্যতিক্রম করা যাবে না। এ ব্যাপারে বিশ্বের বড় বড় আলেমগণও তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইবনে ফারেস, কাজী আইয়াজ, ফকীহ আবু বকর বিন আরবি, শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, মরহুম শেখ মুহাম্মদ রশিদ রেজা, আশরাফ আলী থানভি (রহ.), শেখ মোহাম্মদ আবদুল আজিম আল জুরকানি (আল-আজহার, মিসর), শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ দরাজ (মিসর), শেখ জাফর আহমদ ওসমানী, মুফতি মোহাম্মদ শফি (রহ.), শেখ তাহের আহমদ জাভি (লিবিয়া), শেখ আবদুল্লাহ বিন ইবরাহিম আল আনসারী (দোহা, কাতার), শেখ মুফতি মাহমুদ হাসান কানকুহি (ভারত), শেখ আবদুল হামিদ তাহমাজ (রিয়াদ), মাওলানা মহিউদ্দীন খান, (সম্পাদক, মাসিক মদীনা, বাংলাদেশ), মুফতি আবদুর রহমান (প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা), মরহুম শেখ আজিজুল হক, শেখ কামাল উদ্দিন জাফরী, প্রিন্সিপ্যাল জামেয়া কাসেমিয়া, নরসিংদী; সাইয়েদ আনোয়ার হোসেন, খতিব, আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ, চট্টগ্রাম। শ্রদ্ধেয় আলেমদের সবাই বলেছেন, আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় আরবি হরফের সঠিক উচ্চারণ হয় না, তাই অন্য কোনো ভাষায় উচ্চারণ করে কোরআন পড়লে তা হবে ভুল। সম্মানিত আলেমদের মতামত উল্লেখ করে এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. হাফেজ আবুল বারাকাত মুহাম্মাদ হিজবুল্লাহ প্রণীত ‘উজুবু কিতাবুল মাসহাফুস-শারীফ বিল-হরূফুল আরাবিয়া মায়াল ইলতিজামি বিররুসমিল উসমানি’ গ্রন্থে।

যা হোক, মূল কথা হলো আল্লাহর কোরআন পড়তে হবে আল্লাহ যে ভাষায়, যে উচ্চারণে নাজিল করেছেন সে ভাষার উচ্চারণেই। তাহলেই কেবল সাওয়াব আশা করা যেতে পারে, অন্যথায় গুনাহও হতে পারে। আল্লাহ আমাদের সহিহ-শুদ্ধভাবে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের সঠিক জ্ঞান দান করুন।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :জুন ৩, ২০১৭ ১:৪০ অপরাহ্ণ