২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৩:৪৩

মানব পাচারকারী চক্র রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে তৎপরতা চালাচ্ছে

কায়সার হামিদ মানিক,উখিয়া :
মিয়ানমারে উত্তর রাখাইনে সেনাবাহিনী ও জাতীয়তাবাদী উগ্র রাখাইন বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের কবল থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ নির্যাতিত অসহায় রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ৬০ শতাংশের অধিক নারী ও শিশু। এদের অধিকাংশ দুঃস্থ, অনাথ ও অবলা। এধরনের দুঃস্থ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির অসহায়ত্বের সুযোগ দিতে নারী, শিশু ও মানব পাচারকারী চক্র রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
রাখাইনে জাতিগত শুদ্বি অভিযান চালাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সেখানকার উগ্র জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসীরা। ইতিমধ্যে জাতিসংঘের প্রাথমিক তথ্যমতে চার লাখ ২৫ হাজারের বেশী রোহিঙ্গা মুসলমান রাখাইনে তাদের ভিটেমাটি, সহায় সম্পদ, বাপদাদার জন্ম স্থান, ঘরবাড়ি পিছনে ফেলে রেখে পালিয়ে এসে কোন রকমে জান হাতে নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মতে তারা যেন দোজগের আগুন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের স্বর্গে এসেছে। ছেলে, মেয়ে, স্বামী, বোন, পিতা মাতা, স্ত্রী সহ অতি নিকটজন হারানোর বেদনার শোক যেন তাদের পিছু ছাড়ছে না। এরপরও এসব রোহিঙ্গাদের মাঝে বিরাজ করছে স্বস্তি ও প্রশান্তি।
গতকাল শুক্রবার বিকালে কথা হয় উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বাঘঘোনা পাহাড়ি জঙ্গলে গড়ে উঠা অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা মাষ্টার ইউছুপ জালাল (৪২) এর সাথে। রাখাইনে মোটামুটি লেখা পড়া জানা হওয়ায় লোকজন তাকে মাষ্টার বলে ডাকে। তিনি জানান, এতগুলো মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে বাংলাদেশে সহানুভূতি ও করুনায় এখানে আশ্রয় পেয়েছে। যদি বাংলাদেশ
মুসলিম রাষ্ট্র না হতো হয়ত এতদিনে পৃথিবীর বুক থেকে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যেত। তিনি জানান, একটি জাতিগোষ্ঠিকে এক বা দুই বার অধিকার আদায়ের জন্য কষ্ট স্বীকার করতে হয়। আর তাও যদি সেই জাতি গোষ্ঠির মাঝে সঠিক দিকনির্দেশক বা বিশ্বস্থ নেতৃত্ব থাকে। যেমনটি বাংলাদেশে ক্ষেত্রে হয়েছিল। বাংলাদেশে মানুষ ১৯৭১ সালে তাদের সঠিক ও বিশ্বস্থ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। বাংলাদেশের মানুষকে ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু, শরনার্থী হয়েছিল কোটি কোটি মানুষকে। তিনি জানান, কিন্তু রোহিঙ্গারা হতভাগা জনগোষ্ঠি, কারন তাদের নেতৃত্বে রয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা, অনৈক্য ও লোভ। এদের ডাকে বার বার রোহিঙ্গারা দেশান্তরিত হয়েছে ও হচ্ছে। কিন্তু সঠিক নির্ভরযোগ্য নেতৃত্বের অভাব ও অনৈক্যের কারনে কোন চুড়ান্ত সফলতার মুখ রোহিঙ্গারা দেখতে পারছে না। একই দাবি ও অভিমত অধিকাংশ নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের।
নিজ দেশে, মাতৃ ভূমিতে, স্বদেশের সরকার, সেনাবাহিনী ও জাতীয়তাবাদী সংখ্যাগুরু উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের হাতে বার বার নির্মম, অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ অভিমুখে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিতে হচ্ছে। জাতিসংঘ শরনার্থী সংস্থা, শিশু তহবিল, অভিবাসন সংস্থা সহ বিভিন্ন সংস্থার মতে, গত ২৫ আগষ্টের পর থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অন্ততঃ ৬০ শতাংশ নারী ও শিশু। এর সাথে যুক্ত আছে উল্লেখ যোগ্য একটি অংশ বয়স্ক। বলা যায় রোহিঙ্গা শরনার্থীদের বিরাট একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দুঃস্থ, অনাথ, কর্মঅক্ষম। একেবারে দুঃস্থ প্রকৃতির বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরনার্থীদের অসহায় বলা চলে। উখিয়া বালুখালী, কুতুপালং স্থায়ী শরনার্থী শিবির ছাড়াও তাজনিমার খোলা, হাকিমপাড়া, বাঘঘোনা অস্থায়ী শরনার্থী শিবিরে গতকাল পর্যন্ত নতুন ভাবে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। জাতিসংঘের ধারনা অনুযায়ী ৪লক্ষ ২৫ হাজারের মত রোহিঙ্গা আশ্রয় নিলেও বাকি অংশটি টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী ভাবে আশ্রয়ে রয়েছে। গতকালও মিয়ানমারের রাখাইনের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু কিছু রোহিঙ্গাদের পালিয়ে এসে এসব শরনার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে।
বিভিন্ন সংস্থা ও সচেতন মহলের মতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরনার্থীদের চরম ক্ষুধা, দারিদ্রতা, আশ্রয়হীনতার অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে বিভিন্ন নারী ও শিশু সহ মানব পাচারকারীর চক্রের তৎপরতা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দেখা যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব অসহায় রোহিঙ্গাদের ত্রান সহায়তার নামে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা এসব শিবিরগুলোতে অবস্থান নিয়ে তাদের পুরোনো স্থানীয় ও রোহিঙ্গা সহযোগীদের সাথে হাত মিলাচ্ছে। এরা বিশাল সংখ্যক অসহায় রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের নানা ধরনের প্রলোভন ও ফাঁদে ফেলে বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে ভাল মোটা বেতনের চাকুরীর লোভ দেখিয়ে ভাগানোর চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। অনেককে রোহিঙ্গা শিশু ও মেয়েদের ঘরবাড়িতে কাজ দেওয়ার নাম করে নিয়ে যাওয়ারও খবর পাওয়া যাচ্ছে। এদের সাথে যুক্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী শিশু ও মানব পাচারকারী চক্র। এসব চক্র রোহিঙ্গা শিবিরগুলো থেকে অসহায় কিশোরী, যুবতী ও অবলা নারীদের নানা প্রলোভনে ভারত, পাকিস্তান, সৌদিআরব সহ বিভিন্ন দেশে পাচার করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। প্রতিদিন সর্বত্র রোহিঙ্গা নিখোঁজ শিশুদের সন্ধান চেয়ে মাইকিং করতে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি ছেলেধরা সন্দেহে রোহিঙ্গারা পিটিয়ে অপর রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে।
এব্যাপারে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমএর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের মুখপাত্র ক্যারিস লোম রয়টার্সকে জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে অভিবাসন সংস্থা সচেতন রয়েছে। ইতিমধ্যে কক্সবাজারের সীমান্তবতী রোহিঙ্গা শিবির গুলোতে নারী, শিশু ও মানব পাচার প্রতিরোধক বিশেষঞ্জ কাজ শুরু করেছে। তিনি জানান পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের এ অবস্থায় যে কেউ করুণা ও অনুকম্পা দেখাতে নানা স্থান থেকে ছুটে আসছেন। কিন্তু এসব রোহিঙ্গাদের হাতে কোন অর্থ নেই, খাবার নেই, বিশুদ্ধ পায় নেই, আশ্রয়স্থলের অভাব তদুপরি এসব রোহিঙ্গাদের ভাষাগত সমস্যাও রয়েছে। এধরণের রোহিঙ্গাদের মাঝে ধারনা জন্মাচ্ছে তাদের হয়ত এখানে করুণার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে। তাদের এ অবস্থা ও মনোভাবকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে পাচারকারী চক্র সুযোগ নিতে নেমে পড়েছে বলে জানা গেছে। আই.ও.এম. এর এক মূখপাত্র জানান সম্ভাব্য, করুণা ও সাহায্য থেকে রোহিঙ্গাদের মুখ ফেরাতে ও পাচারকারীদের কাছ থেকে সচেতন করতে প্রয়োজন সু-শৃংখল শরনার্থী শিবির ব্যবস্থাপনা, সুনির্দিষ্ট আশ্রয় স্থল ও খাবারের ব্যবস্থা করা।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৭ ৬:৫৭ অপরাহ্ণ