১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১০:০৬

হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি ৩ কোটির এলসিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক:

মাত্র তিন কোটি ৪৭ লাখ টাকার এলসি (ঋণপত্র) খুলে এক হাজার ৪০ কোটি টাকার অবৈধ পণ্য আমদানি করেছে দুটি প্রতিষ্ঠান। মেসার্স হেনান আনহুই এগ্রো এলসি ও এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি নামের প্রতিষ্ঠান দুটি এ জালিয়াতি করতে মিথ্যা নাম-ঠিকানা ও ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এলসি খুলে ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আমদানি করে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটনাটি জালিয়াতির মাধ্যমে সবচেয়ে বড় শুল্ক ও মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে শুল্ক গোয়েন্দা তদন্ত অধিদফতর। সম্প্রতি অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বরাবর এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শুল্ক গোয়েন্দা তদন্ত অধিদফতরের নিকট গোপন সংবাদ ছিল যে, চট্টগ্রাম বন্দরে ১২টি কন্টেইনারে পোল্ট্রি ফিডের ক্যাপিটাল মেশিনারি ঘোষণা দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আমদানি নিয়ন্ত্রিত ও আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য আমদানি করে খালাসের চেষ্টা করা হচ্ছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা গত ৫ ও ৬ মার্চ বন্দর কাস্টমস ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতিতে ইনভেন্টরি (বর্ণনামূলক তালিকা)করে বর্ণিত ১২টি কন্টেইনারে ক্যাপিটাল মেশিনারির পরিবর্তে প্রায় ১৩৮ কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ সিগারেট, এলইডি টেলিভিশন, পুরাতন ফটোকপি মেশিন, মদ ও গুঁড়োদুধ পান।

পরবর্তীতে তদন্তে দেখা যায়, আমদানিকারক গত এক বছরে আরও ৭৮টি কন্টেইনার খালাস নিয়েছেন। সর্বশেষ মিথ্যা ঘোষণায় আনা ১২টি কন্টেইনারের পণ্যের উপস্থিতি দেখে ধারণা করা যায়, পূর্বে খালাস করা পণ্যেও একইভাবে অবৈধ পণ্য আনা হয়েছে। সেই হিসেবে ৭৮টি কন্টেইনারের মোট মূল্য দাঁড়ায় এক হাজার ৪০ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পরিশোধ হয়েছে মাত্র তিন কোটি ৪৭ লাখ টাকা। বাকি টাকা অবৈধ পন্থায় (হুন্ডি) পাচার করা হয়েছে। যা সাম্প্রতিক সময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে সবচেয়ে বড় শুল্ক ও মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্যসমূহ জব্দ করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য প্রতিবেদন গত ৯ মার্চ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রেরণ করা হয়। ওই ঘটনার সঙ্গে আমদানি নীতি আদেশ ভঙ্গ ছাড়াও অন্য কোনো ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা- তা নিরূপণের নিমিত্তে দফতরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ জাকির হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। অনুসন্ধানের স্বার্থে গঠিত কমিটির আরও পাঁচ সদস্যকে কো-অপট (সংযুক্ত) করে।

গঠিত কমিটি দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে অপরাধের ধরন ও দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য একটি প্রতিবেদন দাখিল করে।

দাখিল করা প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, মেসার্স হেনান আনহুই এগ্রো এলসি, খিলক্ষেত, ঢাকা এবং এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা কর্তৃক আইএফআইসি ব্যাংক, নয়াপল্টন শাখার মাধ্যমে এলসি খুলে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ঘোষণায় প্রতিটি চালানে ছয়টি কর দুটি চালানে মোট ১২টি কন্টেইনার আমদানি করে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আবদুল মোতালেব। ঠিকানা- গ্রাম: পাতিরা, ইউনিয়ন: ডুমনী, থানা: খিলক্ষেত। জনৈক খোরশেদ আলমের ছবি আবদুল মোতালেব হিসেবে ব্যবহার করে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এলসি খুলে ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আমদানি করা হয় এবং সিএন্ডএফ এজেন্ট মেসার্স রাবেয়া অ্যান্ড সন্স’র মাধ্যমে অন-চেসিস ডেলিভারি নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে স্ক্যানিং প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় আমাদনি নিষিদ্ধ ও শর্তযুক্ত পণ্যকে পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মূলধনী যন্ত্রপাতি ঘোষণা দিয়ে খালাস নেয়ার অপচেষ্টা করা হয়।

পূর্বে একইভাবে ওই আমদানিকারক ১৫টি চালানে ৭৮টি কন্টেইনার খালাস নেন। মূল্য সংযোজন কর বিভাগীয় দফতর গুলশান ও লালবাগ হতে প্রাপ্ত তথ্যাদি অনুসারে ওই প্রতিষ্ঠান দুটির নিবন্ধনের প্রকৃতি সাপ্লাইয়ার (ট্রেড) ও ইমপোর্টার। কিন্তু কাস্টম আউস চট্টগ্রামে দাখিলকৃত দলিলাদিতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান দুটির নিবন্ধনের প্রকৃতি ম্যানুফ্যাকচারার। অথচ অনুসন্ধানে দেখা যায়, মুরগির খাবার তৈরির কারখানার কথা বলে এসব চালান আনা হলেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই।

অন্যদিকে ব্যাংকিং তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আইএফআইসি ব্যাংকের কেওয়াইসি (গ্রাহক সম্পর্কে পরিচয়) ফরমে দাখিল করা তথ্যাদি ভুয়া। এলসি ও অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত কাগজপত্রে চরমভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। তাদের এ অপকর্মে যে সকল অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা হচ্ছে-

প্রথমত : মোট ৯০টি কন্টেইনার আমদানিতে শুল্ক ফাঁকির অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ফাঁকি দেয়া রাজস্ব আদায় ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ইতোমধ্যে কাস্টাম হাউস, চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত : পণ্য আমাদনির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইএফআইসি ব্যাংকের মাধ্যমে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলসি ও অ্যাকাউন্ট খোলা এবং লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ও ব্যাংকের তত্ত্বাবধানকারী সিনিয়র কর্মকর্তাদের চরম দায়িত্বহীনতা, তাদের যোগসাজস আছে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। মিথ্যা ওই ঘোষণার কারণে প্রায় ২৬৭ কোটি ২১ লাখ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর কর্তৃক মামলা দায়ের ও তদন্তযোগ্য। প্রযোজ্য অন্যান্য আইনেও ব্যবস্থা নেয়া যায়।

তৃতীয়ত : পণ্য খালাসের সময় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে গাফিলতি এবং সংঘটিত অপরাধে সম্পৃক্তাতার ইঙ্গিত রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজস ব্যতীত এ ধরনের বড় বাণিজ্যিক জালিয়াতির মাধ্যমে চোরাচালন (৯০টি কন্টেইনার) সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয় মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। গভীর তদন্তে এসব কর্মকর্তাদের শনাক্ত ও আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যায়। এক্ষেত্রে বিভাগীয় ও অন্যান্য ব্যবস্থা প্রযোজ্য।

চতুর্থত : সিএন্ডএফ এজেন্ট মেসার্স রাবেয়া অ্যান্ড সন্স কর্তৃক মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্য খালাসের চেষ্টা গ্রহণ লাইসেন্সিং বিধিমালা ২০১৬ এর সংশ্লিষ্ট বিধি ২১ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

পঞ্চমত : চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের শুল্কায়ন কর্মকর্তাগণ কর্তৃক মূসক-৭ যাচাই করা হয়নি। আলোচ্য প্রতিষ্ঠান দুটির সর্বপ্রথম আমদানি করা পণ্য চালানসমূহের শুল্কায়নকালে কর্মকর্তাগণ কর্তৃক মূসক-৭ এর সঠিকতা সংশ্লিষ্ট ভ্যাট বিভাগ/সার্কেলে যোগাযোগ করে যাচাই করা উচিত ছিল। তাহলে মূসক-৭ এর জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ত এবং আমদানিকারক পরবর্তী পণ্যচালানগুলোর আমদানির সুযোগ পেত না। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান দুটির আমদানি করা পণ্যচালানসমূহের শুল্কায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।

ষষ্ঠত : পণ্য স্ক্যানিং ও অন-চেসিস ডেলিভারির ক্ষেত্রে প্রচলিত আদেশ/পদ্ধতির মধ্যে কিছু দুর্বলতা থাকায় এ ধরনের অপঘোষণার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিধায় তা রোধে খালাস পদ্ধতিতে সংস্কারের সুপারিশ রাখা হয়েছে।

সপ্তমত : আলোচ্য ঘটনার ফৌজদারি ও বিভাগীয় গভীর তদন্তের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তদন্ত পর্যায়ে আরও নির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে জাইলে শুল্ক গোয়েন্দা তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, এ বিষয়ে এনবিআরকে আমরা মামলা দায়েরের জন্য সুপারিশ করেছি। ইতোমধ্যে এনবিআর মামলা দায়েরের সুপারিশ অনুমোদনও করেছে। আমরা এখন পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

তিনি আরও বলেন, এ অপরাধে প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা জড়িত আছে কি না- তা চিহ্নিত করার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই ঘটনায় ফৌজদারি মামলা দায়েরের জন্য প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এখন আমরা এনবিআরের নির্দেশ মতো কাজ করছি।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :আগস্ট ২৯, ২০১৭ ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ