২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:৪২

চার জেলার চরাঞ্চলের ২১০টি গ্রামে প্লাবিত হয়

মো: গোলাম আযম সরকার (রংপুর) :
ভারত গজলডোবার সব কটি গেট খুলে দেয়ায় তিস্তার তীব্র স্রোত আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশ অংশের লালমানিরহাটের ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে এই পয়েন্টে তিস্তায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৬ সেন্টিমিটার। ব্যারাজ রক্ষায় ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে তিস্তার ভাটিতে হুহু করে ঢুকছে পানি। ফলে তিস্তা অববাহিকার ১৫২ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল ছাড়াও নদী তীরবর্তী নি¤œাঞ্চলে গ্রামের পর গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার হেক্টর ভুট্টা, পাটসহ ফসলি জমি এখন তিস্তার পানির নিচে। শত শত পুকুর তলিয়ে লাখ লাখ টাকার মাছ চলে গেছে বাইরে।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রগুলোর তথ্য মতে, তিস্তায় হঠাৎ অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার সদর, গজঘণ্টা, লক্ষ্মীটারী, কোলকোন্দ, আলমবিদিতর, নোহালী এবং কাউনিয়ার বালাপাড়া ও হারাগাছ এবং পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর ও মধুপুর ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোলকোন্দ ইউনিয়ন।
গজঘণ্টা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম জানান, আমার ইউনিয়নের প্রায় চার হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ছালাপাক এলাকায় দেখা দিয়েছে ভাঙন।
নোহালী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ টিটুল জানান, আমার এলাকার তিন হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। আমরা স্থানীয়ভাবে তাদের সহযোগিতা করছি। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে মহা দুর্ভোগে পড়বে আমার ইউনিয়নবাসী।
কোলকন্দ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন রাজু জানান, আমার ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার প্রায় আড়াই হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
উপজেলার নোহালী ইউনিয়নের চর নোহালী, চর বাগডহরা, আলমবিদিতর ইউনিয়নের পাইকান হাজীপাড়া, কোলকোন্দ ইউনিয়নের চর চিলাখাল, খলাইর চর, চর বিনবিনা, চর মটুকপুর, জেলেপাড়া, ঢাকের চর, কুড়িবিশ্বা, উত্তর কোলকোন্দ মিয়াজিপাড়া, শিংগিমারী বাঁধেরপাড়, গঙ্গাচড়া ইউনয়নের চর ধামুর, মাঝাপাড়া, গান্নারপাড়, লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চর শঙ্করদহ, পশ্চিম ইচলী, পূর্ব ইচলী, কলাগাছি, মধ্য ইচলী, জয়রামওঝা, গজঘণ্টা ইউনিয়নের চর ছালাপাক, চর রাজবল¬ভ, গাওছিয়া বাজার, মর্নেয়া ইউনিয়নের নিলারপাড়, চর মর্নেয়া, আলাল চর, রমাকান্ত, রামদেব, কামদেব ও ভাঙ্গাগড়া গ্রাম প¬াবিত হয়েছে।
এ দিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তিস্তায় পানি বৃদ্ধির কারণে নীলফামারীর ডোমার, ডালিয়া, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, আদিতমারী, পাটগ্রাম, কালিগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ী, ভুরুঙ্গামারী, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার চরাঞ্চলেও পানি ঢুকছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে এ রকম পরিস্থিতিতে এই চার জেলার চরাঞ্চলের ২১০টি গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে প্রায় দুই লাখ মানুষ প¬াবিত হয়।
উজানের ভারী বর্ষণ আর পাহাড়ী ঢলে নীলফামারীতে তিস্তা নদীর পানি এখনও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্ট বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে করে নদীর তীরবর্তি নীলফামারী দু’টি উপজেলার অন্তত ২৫টি গ্রামের ১০ সহ¯্রাধিক মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে।
ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজার রহমান সাংবাদিকদের জানান, গজলডোবার সবকটি গেট খুলে দেয়ায় রোববার রাতে হঠাৎ করেই ব্যারাজের উজানে ভয়াবহ রকম পানি বৃদ্ধি পায়। এক সময় ব্যারাজ পয়েন্টে পানি ৫২ দশমিক ৭২ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে যা বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপরে। এতে আমরা ব্যারাজের সব কটি জলকপাট খুলে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছি।
নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছচাপানী, গয়াবাড়ি ও জলঢাকা উপজেলার, গোলমু-া, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী ২৫ গ্রাম প¬াবিত হয়েছে। এসব গ্রামের ১০ সহ¯্রাধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে অন্তত পাঁচ সহ¯্রাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামের নজরুল ইসলাম ইসলাম (৪০) সাংবাদিকদের বলেন, নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে ছোটখাতা গ্রামের ছয় শতাধিক বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের উপÑবিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধির কারণে ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রেখে পানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আরো পানি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, বন্যার পূর্বাভাস থাকায় নদীতীরবর্তী এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক করা হয়েছে। তারা এলাকার মানুষকে সতর্ক করছেন নদীর পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, উজানে ঢলে তিস্তা পানি রোববার রাত থেকে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির চাপ নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারেজের সবকটি জলকপাট খুলে দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
এদিকে গাইবান্ধার ফুলছড়িতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় ৪৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। চরাঞ্চল বেষ্টিত ৪৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশপাশে বন্যার পানি ওঠায় পাঠদান বিঘিœত হচ্ছে। এ ছাড়া নতুন করে এরেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের ১৩০টি পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। ভাঙনের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
এরেন্ডাবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, কয়েক দিনের ভাঙনে এরেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের জিগাবাড়ি, পশ্চিম জিগাবাড়ি, হরিচণ্ডি, পাগলারচর এলাকায় নদীভাঙনের কারণে ১৩০টি পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে জিগাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জিগাবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়, এরেন্ডাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ ও জিগাবাড়ি কমিউনিটি ক্লিনিক। তিনি বলেন, নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে এখনো সরকারি কোনো ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়নি। ফুলছড়ি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হেমায়েত আলী শাহ জানান, ব্রহ্মপুত্র নদবেষ্টিত ৪৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশপাশে বন্যার পানি আসায় এসব বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া বিদ্যালয়ে কক্ষে পানি ওঠায় ঝানঝাইড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গলনা কমিউনিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কটকগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি সামান্য হ্রাস পেলেও বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট, অষ্টমীর চর, রমনা, রানীগঞ্জ, চিলমারী ইউনিয়ন, উলিপুর উপজেলার হাতিয়া, বেগমগঞ্জ, রৌমারী উপজেলার শৌলমারী, দাঁতভাঙা, বন্দবের ইউনিয়ন ও সদর উপজেলার যাত্রাপুরসহ ২০ ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চলসহ চরাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ পাঁচ দিন ধরে পানিবন্দী জীবনযাপন করছে।
অনেক পরিবারের ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় ঘরের উঁচু মাচানে পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করছেন। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর কাঁচা সড়ক তলিয়ে থাকায় একমাত্র নৌকায় প্রয়োজনীয় কাজ সারছেন লোকজন।
উলিপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বি এম আবুল হোসেন সাংবাদিকেদের জানান, বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি স্থিতিশীল থাকলেও আমার ইউনিয়নের প্রায় এক হাজার পরিবার পানিবন্দী জীবনযাপন করছে।

দৈনিক দেশজনতা/এন আর

প্রকাশ :জুলাই ১২, ২০১৭ ৮:৫৭ অপরাহ্ণ