নিজস্ব প্রতিবেদক:
বছর ঘুরে আবার এলো সেই ফুল ফোটার দিন। শীতের রিক্ততা মুছে প্রকৃতিজুড়ে সাজ সাজ রব এখন। বিবর্ণ প্রকৃতিতে জেগে উঠেছে নতুন জীবনের ঢেউ। নীল আকাশের সোনাঝরা আলোর মতোই আন্দোলিত হৃদয়। আজ পহেলা ফাল্গুন। বসন্তের প্রথম দিনে আজ নানা আয়োজনে আলোড়িত হবে রাজধানী ঢাকা।
বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে। এছাড়া তরুণ-তরুণীরা বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ, চারুকলা চত্বর, পাবলিক লাইব্রেরি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ধানমন্ডি লেক, বলধা গার্ডেন মাতিয়ে রাখবে সারাদিন। ফোন, ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলবে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময়। আজ দিনভর চলবে বসন্ত বন্দনায়।
বসন্তের প্রকৃত রূপ দেখা যায় গ্রামে; শহরে তেমন নয়। ষড়ঋতুর দেশে আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতিতেই মূলত বসন্ত জানান দেয় তার আগমনী বারতা। গ্রামের মেঠো পথ, নদীর পাড়, বৃক্ষরাজি, মাঠভরা ফসলের ক্ষেত বসন্তে রঙিন হয়ে ওঠে। নিসর্গের বর্ণচ্ছটায় প্রকৃতি হয়ে ওঠে বাঙ্ময়। কচি পাতায় আলোর নাচনের মতোই তখন বাঙালির মনে দোলা লাগে, হৃদয় উচাটন হয়।
বসন্তের সাজে আজ মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হবে। প্রীতির বন্ধনে আপন মহিমায় খুঁজে নেবে বসন্তকে। সেই মিলনের তাগিদে আজ সারা দিন দেশের নানা প্রান্তে বসন্তবরণে মেতে উঠবে জাতি।
বাংলায় বসন্ত উৎসব এখন প্রাণের উৎসবে পরিণত হলেও এর শুরুর একটা ঐতিহ্যময় ইতিহাস আছে, যা অনেকের অজানা। মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম এবং উৎসবের ধরনটা এখনকার মতো ছিল না। কিন্তু অন্য ঋতুর চেয়ে এই ঋতুকে পালন করা হতো আলাদাভাবে। তাই পহেলা ফাল্গুন বা বসন্ত উৎসব কেবল উৎসবে মেতে ওঠার সময় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য, বাঙালিসত্তা। সে ঐতিহ্যের ইতিহাসকে ধরে রাখতে পারলেই বসন্ত উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্ম ছড়িয়ে দিতে পারবে বাঙালি চেতনাকে।
বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি অনাদিকাল থেকেই। কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায় আছে বসন্তের বন্দনা। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে তার আপন মহিমায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিককালের বাউল কবির মনকেও বারবার দুলিয়েছে ঋতুরাজ বসন্ত। বসন্ত শুধু অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তরঙিন পুষ্পিত রক্তের স্মৃতির ওপরও রং ছড়ায়। বায়ান্ন সালের আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
বাংলা পঞ্জিকা বর্ষের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিনকে আমরা পালন করি ‘পহেলা ফাল্গুন-বসন্ত উৎসব’ হিসেবে। এ উৎসব এখন পরিণত হয়েছে বাঙালির নিজস্ব সার্বজনীন প্রাণের উৎসবে। বসন্তের প্রথম মুহূর্তকে ধরে রাখতে তাই তো সবাই মেতে ওঠে নানা উৎসব ও সাজে। বাসন্তি রঙের শাড়িতে বাঙালি নারীকে অপরূপ দেখায়। এতে পিছিয়ে নেই পুরুষরাও। বসন্ত অনেক ফুলের বাহারে সজ্জিত হলেও গাঁদা ফুলের রঙকেই এদিনে তাদের পোশাকে ধারণ করে তরুণ-তরুণীরা। খোঁপায় শোভা পায় গাঁদা ফুলের মালা। বসন্তের আনন্দযজ্ঞ থেকে বাদ যায় না গ্রাম্যজীবনও। আমের মুকুলের সৌরভে আর পিঠাপুলির মৌতাতে গ্রামে বসন্তের আমেজ একটু বেশিই ধরা পড়ে। বসন্তকে তারা বরণ করে আরও নিবিড়ভাবে।
কর্মসূচি : নাচ, গান ও কবিতাসহ নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনে বসন্ত বরণ করবে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ। দীপন সরকারের গিটারে বসন্তবাহার যন্ত্রসংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সকাল ৭টায় চারুকলার বকুলতলায় শুরু হবে এই উৎসব। উৎসবের উদ্বোধনী পর্বে থাকবে বসন্ত কথন পর্ব, আবির বিনিময়, রাখিবন্ধন, ধ্রুপদি, দলীয় নৃত্য ও দলীয় সংগীত। বরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে একক আবৃত্তি ও একক সংগীত পরিবেশন। এ পর্ব শেষ হবে সকাল ১০টায়। এরপর বিকেল সাড়ে ৩টায় একযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলা, লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুরশাহ পার্ক, ধানমণ্ডি ৮ নম্বর রোডসংলগ্ন রবীন্দ্রসরোবর উন্মুক্ত মঞ্চ এবং উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টর রবীন্দ্র সরণির উন্মুক্ত মঞ্চে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে এই আয়োজন। শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করেছে তিন দিনের বসন্ত উৎসব। আজ সকাল ১০টায় এ উৎসব শুরু হবে নন্দন মঞ্চে।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ